গত বছরের শুরুতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দিয়ে শুরু হয় ইউরোপীয় ফুটবলারদের ব্যাপক হারে সৌদি আরব যাত্রা। গ্রীষ্মকালীন দলবদলে সে বহরটি আরও বড় করেন সাদিও মানে, করিম বেনজেমা, রবার্তো ফিরমিনো এবং জর্ডান হেন্ডারসনরা। তবে এর মধ্যে হেন্ডারসনের সৌদি ক্লাব আল ইত্তিফাকে যোগ দেওয়া ছিল ইংলিশ ফুটবলের সমর্থকদের জন্য বড় ধাক্কা। সাবেক লিভারপুল অধিনায়ক হেন্ডারসন যে শুধু মাঠের খেলাতেই নন, মাঠের বাইরেও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র।
ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের কারণে ইংলিশ ফুটবলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজনও ছিলেন এই মিডফিল্ডার। যার ফলে সৌদি যাত্রা নিয়ে বাকিদের চেয়ে হেন্ডারসনকে কথা শুনতে হয়েছে বেশি। তবে সেই হেন্ডারসনই নাকি ফের ইউরোপে ফিরতে চাইছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মেইল অনলাইনসহ একাধিক সংবাদমাধ্যম হেন্ডারসনের ইউরোপে ফেরার ইচ্ছার কথা জানিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। যদিও এ নিয়ে হেন্ডারসনের প্রকাশ্য মন্তব্য শোনা যায়নি।
শেষ পর্যন্ত গুঞ্জন সত্যি করে হেন্ডারসন যদি ইউরোপে ফেরেন, তবে সেটি তাঁর ইউরোপ ছাড়ার মতোই বড় খবর হবে। মেইল অনলাইন অবশ্য জানিয়েছে হেন্ডারসন আল ইত্তিফাক ছেড়ে দিলে কর এবং বেতনের দিক থেকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখ পড়তে হবে তাঁকে। ক্ষতি জেনেও অবশ্য হেন্ডারসন নাকি এখন ফিরতে মরিয়া। এমনকি সেটি ইংল্যান্ডের বাইরেও হতে পারে।
ডেইলি মেইল বলছে, ১ কোটি ২০ লাখ ইউরোতে সৌদি আরব যাওয়া হেন্ডারসন আল ইত্তিফাকে মানিয়ে নেওয়ায় সমস্যাবোধ করছেন। যে কারণে এই মাসে সামনে আসা যেকোনো প্রস্তাবকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। সৌদি পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আল ইত্তিফাকের বর্তমান পারফরম্যান্সও নাকি হেন্ডারসনের সৌদি আরব ছাড়ার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। দলের বাজে ফর্মের কারণে ইত্তিফাক কোচ স্টিভেন জেরার্ডও নাকি বেশ চাপে আছেন। সৌদি প্রো লিগে চলতি মৌসুমে ১৯ ম্যাচ শেষে ৬ জয়, ৬ হার ও ৭ ড্র নিয়ে পয়েন্ট তালিকার ৮ নম্বরে আছে আল ইত্তিফাক।
জেরার্ডের সহকারী ইয়ান ফস্টারের এই সপ্তাহে ক্লাব ছাড়াও নাকি হেন্ডারসনের এই সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রেখেছে। চ্যাম্পিয়নসশিপের দল প্লেমাউথ আর্গিলেতে যোগ দেওয়া ফস্টার লিভারপুল একাডেমিতে জেরার্ডের সঙ্গে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। হেন্ডারসনের সৌদি আরব যাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রভাব ছিল তাঁর। ফস্টারের ক্লাব ছাড়াও নাকি হেন্ডারসনের ভাবনা বদলানোর ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
ডেইলি মেইল বলছে, খেলার ধরনের পাশাপাশি হেন্ডারসন নাকি সৌদি আরবের গরম এবং আর্দ্রতার সঙ্গে মানিয়ে নিতেও হিমশিম খাচ্ছেন। আল ইত্তিফাকের ৩৫ হাজার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্টেডিয়ামে এ মৌসুমে গড়ে ৭ হাজার ৮০০ দর্শকের উপস্থিতিও নাকি হেন্ডারসনের আগ্রহ কমানোয় প্রভাব রেখেছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে গিয়ে নিজের অবস্থান হারানো এবং সমালোচনার মুখে পড়ার বিষয়টি তো আছেই। ফুটবলের বাইরে সব সময় সামাজিক নানা অনিয়ম ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিতি আছে হেন্ডারসনের। সমকামবিরোধিতা, বৈষম্যসহ যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় কথা বলতে দেখা গেছে তাঁকে। যে কারণে সে সময় তাঁর সৌদি আরব যাত্রা অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেননি। সৌদি আরবের দুর্বল মানবাধিকার পরিস্থিতির মধ্যে হেন্ডারসনের নেওয়া সিদ্ধান্ত যৌক্তিক কি না, সে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে।
হেন্ডারসন নাকি তাঁর সতীর্থদের সৌদি প্রো লিগের শীতকালীন বিরতি শুরুর আগেই সম্ভাব্য বিকল্পগুলো বিবেচনা করে দেখার কথা বলেছেন। সৌদি লিগের ওপর হেন্ডারসন নাকি এতটাই বিরক্ত যে প্রিমিয়ার লিগ থেকে কোনো প্রস্তাব পেলে বড় অঙ্কের বেতন হ্রাস এবং বিশাল অঙ্কের কর দিতেও আপত্তি নেই তাঁর। বলে রাখা ভালো, এই মুহূর্তে আল ইত্তিফাক হেন্ডারসনকে কর বাদ দিয়ে সপ্তাহে ৭ লাখ পাউন্ড বেতন দিচ্ছে। তবে কর মওকুফ কার্যকর হবে, যদি তিনি চুক্তি অনুযায়ী দুই বছর থাকেন। আর যোগ দেওয়ার ছয় মাস পর এখন যদি হেন্ডারসন ক্লাব ছাড়েন, তবে তাঁকে ৭ মিলিয়ন পাউন্ডের মতো কর দিতে হবে।
প্রিমিয়ার লিগে এই মুহূর্তে ক্রিস্টাল প্যালেস, ফুলহাম এবং নিউক্যাসল সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের সন্ধানে আছে। তবে এই মুহূর্তে শীর্ষ লিগের অনেক দল খরচের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের মধ্যে আছে, ফলে বেতনের অঙ্কে বড় ছাড় দিয়েই আসতে হবে হেন্ডারসনকে। এদিকে হেন্ডারসনের লিভারপুলে ফেরা নিয়েও কথা হচ্ছে। হেন্ডারসন অবশ্য যেখানে মূল্যায়িত হবেন বা বেশি খেলার সুযোগ পাবেন, সেখানেই যেতে চান।
তাঁকে নিয়ে লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ বলেছেন, ‘ব্যাপারটা এমনই। আমরা আলাপ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম সে থাকুক এটা আমার চাওয়া। কিন্তু সে যে নিয়মিত খেলতে পারবে না, সেটা নিয়েও আমাদের কথা হয়েছিল। আমি একজন খেলোয়াড়কে ৫০ ম্যাচ খেলার কথা বলতে পারি না। কারণ, সেটা আমি জানি না।’ হেন্ডারসনের লিভারপুলে ফেরার পথটা যে এখন প্রায় বন্ধ, সে ইঙ্গিত দিয়ে ক্লপ বলেছেন, ‘যদি আমি বলতাম হেন্ডো আমার প্রধান একজন হবে, সে থাকত, কিন্তু আমি তা বলিনি। তাই অন্য কোথাও যাওয়াই ভালো ছিল।’
তবে হেন্ডারসন যদি প্রিমিয়ার লিগে ফিরে আসেন, তাহলে এ বছরের ইউরোর ইংল্যান্ড দলেও তাঁর জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সাউথগেট অবশ্য বাছাইপর্বের ম্যাচগুলোয় হেন্ডারসনের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। এর মধ্যে গত বছরের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে বিব্রতকর এক পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন ৩৩ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার। সে সময় সাবেক এই লিভারপুল অধিনায়ককে দুয়োও শুনতে হয়েছিল।
শুধু হেন্ডারসনই নন, লিভারপুলের সাবেক ফরোয়ার্ড রবার্তো ফিরমিনোও নাকি সৌদি আরব ছাড়ার কথা ভাবছেন। এর মধ্যে ফুলহাম নাকি তাঁকে নেওয়ার পরিকল্পনাও শুরু করেছে। সব মিলিয়ে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে হেন্ডারসন–ফিরমিনোদের সৌদি লিগ ছাড়ার ইচ্ছা ভবিষ্যতের জন্য বড় বার্তাই দিচ্ছে। অর্থের হাতছানিই সব নয় এবং সৌদি লিগও এখন পর্যন্ত ইউরোপিয়ান তারকাদের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়—এমনটাই নয় কি!