পাকিস্তানের সাবেক বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরান খান। ক্রিকেটের ২২ গজের মতোই মাইনফিল্ডরূপ পাকিস্তানের রাজনীতির ময়দানেও সমানভাবে খেলে চলেছেন তিনি। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতিপক্ষ দলের পিচ ট্যাম্পারিংর মতো এখানেও বারবার ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তিনি।
যদিও বরাবরই অসীম সাহস ও দক্ষতায় সেসব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে জয় ছিনিয়ে এনেছেন। তবে চলতি সপ্তাহে নতুন করে ‘পিচ টেম্পারিং’র কবলে পড়ে প্রায় বিধ্বস্ত কাপ্তান ইমরান খান। কিন্তু এবার এই টেম্পারিংয়ের পেছনে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, খোদ আম্পায়ারই কলকাঠি নেড়েছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই সেই আম্পায়ার।
ইমরান খানের প্যাভিলিয়নে ফেরা নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই মনে হচ্ছে পাক সেনা বাহিনীকে। এমনকি প্রথম বলটি হওয়ার আগেই যেন তা নিশ্চিত হয় সেই ব্যবস্থাই করছে তারা।
ক্রিকেটের ২২ গজ থেকে রাজনীতির ময়দানে
ইমরান খান দীর্ঘ দিন শাসন করেছেন পাকিস্তান ক্রিকেটকে। দাপট দেখিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটেও। শুধু পাকিস্তান নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন ইমরান খান। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে প্রথম ও একমাত্র বিশ্বকাপ জিতিয়ে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। যোগ দেন রাজনীতিতে।
মূলত ক্রিকেটার হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই রাজনীতিতে পা রাখেন ইমরান। গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল কিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই। রাজনীতির জীবনেও সফল হন তিনি। পাকিস্তানের ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয় পায় এবং সরকার গঠন করে তার দল পিটিআই। প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান খান।
দুর্নীতিমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ পাকিস্তান গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন খান। কিন্তু মাঝপথেই ঘটে ছন্দপতন। ২০২২ সালে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন বিরোধীরা। সেই অনাস্থা ভোটের মাধ্যমেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। মাত্র তিন বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে বাধ্য হন ইমরান।
রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা
ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ক্ষমতায় আসে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নেতৃত্বাধীন জোট। যার প্রধানমন্ত্রী হন পিএমএল-এন নেতা শাহবাজ শরিফ। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই।
পিটিআই’র অভিযোগ, পিএমএল-এন ও পিপিপি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইমরান খানকে রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা চলছে। সেই লক্ষ্যেই তার বিরুদ্ধে প্রায় ১৫০টি আইনি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে মনে করে দলটির নেতাকর্মীরা।
এসব মামলার মধ্যে গত মার্চে আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট পরে তার গ্রেফতারকে অবৈধ ঘোষণা করে। এরপর রাষ্ট্রীয় উপহার সামগ্রী বিক্রির অভিযোগে হওয়া একটি মামলায় (তোশাখানা দুর্নীতি মামলা বলেও পরিচিত) চলতি বছরের মে মাসে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
ওই মামলায় তার তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই আগামী পাঁচ বছর তিনি কোনো সরকারি পদে বসতে পারবেন না বলেও নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন ইসিপি। যদিও পরে এই সাজা স্থগিত করেন উচ্চ আদালত।
মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়া বা দলীয় প্রধানের পদে থাকার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় ইমরান খানকে। ফলে পিটিআই চেয়ারম্যানের পদ থেকেও বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। সেই জায়গায় দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ইমরান খানের আইনজীবী গহর আলি খান।
তোশাখানা দুর্নীতি মামলার পর ইমরান খানকে রাষ্ট্রীয় নথি ফাঁসের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় এবং এই মামলায় এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন। এদিকে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু তার নির্বাচনে অংশ নেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন তার মনোনয়ন বাতিল করেছে।
খেলতে হচ্ছে ‘ব্যাট’ ছাড়াই!
ক্রিকেটার ইমরান খান তার দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ‘ব্যাট’ই বেছে নিয়েছিলেন। এই ‘ব্যাট’ প্রতীক নিয়েই এতদিন নির্বাচন করে এসেছে তার দল। ২০১৮ সালের নির্বাচন এই প্রতীকেই জিতেছিলেন খান।
সরকার বদল রাজনীতির নটরাজ নওয়াজ শরিফের ‘লন্ডন গেইম প্লান’য়ে নির্বাচন সামনে করে ইমরান খানের ‘ব্যাট’ কেড়ে নেয়া হয়েছে। নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে গত মাসের শেষ দিকে নির্বাচন কমিশনের দেয়া একটি রায় পিটিআই চ্যালেঞ্জ করলেও গত বুধবার (৩ জানুয়ারি) এক রায়ে বহাল রেখেছে পেশোয়ার হাইকোর্ট।
ইমরান জেলে থাকলেও তার দল পিটিআই ভোটে অংশ নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচনী প্রতীক ‘ব্যাট’ বজায় রাখতে পিটিআইয়ের সাংগঠনিক নির্বাচন সেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল দেশটির নির্বাচন কমিশন।
সেই নির্দেশ মেনে গত ডিসেম্বরে পিটিআইয়ের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ইমরান ঘনিষ্ঠ নেতা গহর আলি খান। তবে সংবিধান মেনে নির্বাচন হয়নি-এমন অভিযোগে গত ২২ ডিসেম্বর দলটির প্রতীক বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যায় পিটিআই। গত ২৬ ডিসেম্বর এ বিষয়ে এক শুনানির পর নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন পেশোয়ার হাইকোর্ট। আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে নির্বাচন কমিশন।
বুধবার (৩ জানুয়ারি) প্রতীক বাতিলে নির্বাচন কমিশনের দেয়া সিদ্ধান্তই বহাল রেখে রায় দেন আদালত। যদিও এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পিটিআই।
নির্বাচনি দামামার একেবারে শেষ সময়ে এসে ‘আম্পায়ারের’ এমন সিদ্ধান্তে তাজ্জব বনে গেছে গোটা পিটিআই টিম! কমিশনের এই ঘোষণায় ক্ষুব্ধ পিটিআই নেতারা বলছেন, ‘লন্ডন গেম প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসিপি।
ইসিপির এই রায়ের ফলে-ইমরান খানের দলের সব প্রার্থীই পলকে হয়ে গেছেন ‘স্বতন্ত্র’। এদিন নির্বাচন কমিশনের ৫ সদস্যের বেঞ্চ তাদের সংরক্ষিত রায়টি প্রকাশ করে। এতে সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজা।
তবে শুধু দলীয় প্রতীক কেড়ে নিয়েই ক্ষ্যান্ত থাকেনি ইসিবি। রায়ে পিটিআইয়ের নির্বাচনকে বেআইনি বলেও ঘোষণা দিয়েছে তারা। রায়ে দলটির নিজস্ব গঠনতন্ত্র ‘নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের আদেশে চেয়ারম্যান পদ হারিয়েছেন পিটিআই’র গহর আলি খানও। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘আমাদের নির্দেশনা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে পিটিআই। তারা ২০১৯ সালের সংবিধান, ২০১৭ সালের নির্বাচনি আইন ও ২০১৭ সালের নির্বাচনসংক্রান্ত নিয়মকানুন অনুযায়ী দলের ভেতর নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে ইসিপির এমন সিদ্ধান্তের পর গহর আলি খান ঘোষণা দিয়েছেন, ইসিপির রায় প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পেশোয়ার হাইকোর্ট (পিএইচসি) বা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবে তার দল।