পিরোজপুর-২ আসনে হারের আশঙ্কায় নিজ দলীয় প্রতীক বাইসাইকেল ছেড়ে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে ১৪ দলের ব্যানারে নির্বাচন করছেন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তবে তাতেও স্বস্তিতে নেই তিনি।
চার দশক ধরে তার গড়ে তোলা দুর্গে এবকার হানা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পিরোজপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি একই আসনে ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
মঞ্জু নৌকা প্রতীক পেলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের তেমন কোন নেতাকর্মী তার সাথে নেই। এমনকি তার নিজ দল জেপিরও বড় একটা অংশ সাম্প্রতিক সময়ে জেপি থেকে পদত্যাগ করে মহারাজের সাথে যোগ দিয়েছেন।
দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে পিরোজপুরের এ আসনে জেপি আধিপত্য ধরে রেখেছিল। সারা দেশে সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকলেও একসময় পিরোজপুরের প্রতিটি উপজেলায় ছিল জেপির শক্ত অবস্থান। তবে সেই সুদিন পেরিয়ে গত কয়েকটি নির্বাচনে আধিপত্য বজায় ছিল কেবল পিরোজপুর-২ আসনে। দলীয় প্রতীক সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন সময় এসব উপজেলায় জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাও হারিয়েছে দলটি। এবারের সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট আরও কঠিন হয়ে পড়েছে দলটির জন্য।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিন উপজেলার আওয়ামী লীগের ৯৫ শতাংশ নেতাকর্মী ও প্রায় শতভাগ জনপ্রতিনিধি স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। এমনকি মহারাজের নির্বাচনী প্রচারণায় জেপির নেতাকর্মীরাও অংশ নিচ্ছেন। এ নিয়ে ভোটের রাজনীতিতে চলছে নানা সমীকরণ।
কাউখালি, ভাণ্ডারিয়া ও নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর-২ আসন। তিনটি উপজেলায় মোট ইউনিয়নের সংখ্যা ২১টি। দেখা যায়, নির্বাচনী এ আসনের তিন উপজেলা চেয়ারম্যানই স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতীক ঈগলের পক্ষে জোরেশোরে কাজ করছেন।
এ আসনে রয়েছে দুটি পৌরসভা। এগুলোর দুই মেয়রও মহারাজের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় দিনরাত কাজ করছেন। এছাড়াও পিরোজপুর-২ আসনে থাকা ২১ ইউনিয়নের মধ্যে একটি বাদে বাকি ২০ ইউপি চেয়ারম্যানকেও ঈগলের পক্ষে কাজ করতে দেখা গেছে। তিন উপজেলায় সাধারণ ও সংরক্ষিত মহিলা মিলিয়ে ৬ ভাইস-চেয়ারম্যানের ৪ জনই ঈগলের হয়ে প্রতিদিন গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন।
একই পরিসংখ্যান লক্ষ্য করা গেছে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও। বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, জেপি প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজের নিজ উপজেলা ভাণ্ডারিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভা মেয়র খসরু জমাদ্দার এবং সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলামসহ দলটির অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের শতভাগ নেতাকর্মী কাজ করছেন ঈগলের পক্ষে।
ভাণ্ডারিয়া আওয়ামী লীগের কেউই নৌকার পক্ষে কাজ করছে না। কাউখালি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ বড় একটি অংশ সকাল সন্ধ্যা ঈগলের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। একই অবস্থা নেছারাবাদ উপজেলাতেও। সেখানেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটির বেশিরভাগ নেতাকর্মী মহিউদ্দিন মহারাজের পক্ষে কাজ করছেন।
তবে কাউখালি ও নেছারাবাদ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিদের এ পর্যন্ত দুদিন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সমর্থনে পথসভায় মঞ্চে দেখা গেছে। তবে তাদের অনুসারী আওয়ামী লীগের অন্য কোন নেতাকর্মী মঞ্জুর পক্ষে মাঠে নামেননি।
এদিকে, ভাণ্ডারিয়া উপজেলা জাতীয় পার্টির (জেপি) বর্তমান কমিটি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পক্ষে মাঠে কাজ করলেও সদ্য বিদায়ী কমিটির সভাপতি-মহাসচিবসহ বেশির ভাগ নেতা মহারাজের পক্ষে কাজ করছেন। যদিও ভাণ্ডারিয়া উপজেলা জেপি বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও উপজেলা যুব সংহতির শীর্ষ নেতা মামুন সরদারসহ দলটির ১১ নেতাই চাঁদাবাজি ও অস্ত্র মামলায় বর্তমানে কারাগারে।
আর কাউখালি উপজেলার জেপি সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাঈদ মিয়া মনু গত অক্টোবরে প্রায় ৩ হাজার নেতাকর্মী নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জেপি থেকে পদত্যাগ করে মহারাজের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তারা এখন সকলেই ঈগল মার্কায় মহারাজের পক্ষে কাজ করছেন। এর বাইরে নেছারাবাদে জেপির কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। সব মিলিয়ে তিন উপজেলার কোনও জায়গাতেই শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছেন না বর্ষীয়ান রাজনীতিক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এ কারণে এখন পর্যন্ত তার পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও তেমন চোখে পড়েনি।
অন্যদিকে, প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই প্রতিদিন সব ইউনিয়নে হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে ঈগলের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন মহিউদ্দিন মহারাজ ও তার নেতাকর্মীরা।
এ নিয়ে নেছারাবাদ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য আব্দুল হক বলেন, ‘আগের নির্বাচনগুলোতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাইকেল নিয়ে নৌকাকে ডুবিয়ে ছিলেন। আবার সে নৌকাতে চড়ে বিজয়ী হয়ে সাইকেলে চলে যাবেন। এ কারণেই আমি তাকে সমর্থন করি না। মহিউদ্দিন মহারাজ ঈগল মার্কা নিয়ে নির্বাচন করলেও তিনি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। নেছারাবাদসহ তিন উপজেলা থেকে মহিউদ্দিন মহারাজ বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতবেন।’
নেছারাবাদ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গোলাম কবির বলেন, ‘আমি প্রত্যক্ষভাবে মহারাজের সাথে এখনও নামিনি। তবে বেশিরভাগ মানুষ মহারাজের পক্ষে। হয়তো আমিও নামবো। তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।’
ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও জেপির পদত্যাগ করা কমিটির সাবেক উপজেলা মহাসচিব মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নৌকা পেলেও আর জিততে পারবেন না। তিনি সব ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট দিতে কর্মী খুঁজে পাবেন না। স্বতন্ত্র প্রার্থী মহারাজ বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হবেন। তার বিজয়ের জন্য জেপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এক হয়ে আমরা মাঠে কাজ করছি।’
তবে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর চাচাতো ভাই ও জেপির প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহিবুল হোসেন মাহিম বলেন, জেপির সাংগঠনিক সংকট নেই। তবে আসন পুনর্বিন্যাস করায় ইন্দুরকানী বাদ দেয়ায় সংকটে পড়তে হয়েছে। দুই উপজেলার চেয়ে নতুন সংযুক্ত নেছারাবাদে ভোটার বেশি। সেখানে আমাদের সাইকেল প্রতীক ভোটারদের কাছে পরিচিত নয়। এজন্য নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে হচ্ছে। ভোটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।’
এ বিষয়ে ঈগল মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মঞ্জু সাহেবের তুলনায় শক্তিশালী প্রার্থী নয়। যেহেতু জনগণ জোট বেঁধেছে, জনগণ ভোট দিতে চাচ্ছে, আমি মনে করি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জনগণ ভোট দেবে। সুন্দর নির্বাচন যদি হয়, আমি আশাবাদী জনগণ ৮০ ভাগ ভোট দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাকে বিজয়ী করে পাঠাবেন।’
মহারাজ আরও বলেন, ‘আমি আমার বিজয়ের ক্ষেত্রে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখি না, যদি প্রশাসনিকভাবে কোনও হস্তক্ষেপ না করা হয়। প্রতিপক্ষ প্রার্থীর লোকজন পরাজয় বুঝতে পেরে নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে বলেও জানান তিনি।