দেশের বাইরে গিয়ে কোচিং করানো অনেক কোচের কাছেই বড় এক চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ উতরাতে পেরেছেন কি আজমল হোসেন?
‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। নিজের সব অভিজ্ঞতা ঢেলে দিয়েছি। কিন্তু কাজ করতে হয়েছে অনেক সমস্যার মধ্যে। এত সমস্যা যে বলার মতো নয়’—বলেছেন বিদ্যুৎ নামে বেশি পরিচিত নারায়ণগঞ্জ থেকে উঠে আসা জাতীয় দলের সাবেক এই ফুটবলার।
গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র ফুটবল কোচ হিসেবে বিদেশে কোচিং করাতে গিয়েছিলেন। ভুটানের প্রিমিয়ার লিগে থিম্পু রেভেন এফসির কোচ হন। ১০ দলের লিগ জুলাইয়ের মাঝামাঝি শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ২ ডিসেম্বর।
১৮ ম্যাচের মধ্যে আজমলের দল জিতেছে মাত্র ৩টিতে, ১টিতে ড্র। ১০ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার ৯–এ ছিল দলটি। ১৮ গোল করে রেভেন এফসি ৬৮ গোল খেয়েছে। হোম ম্যাচে খেয়েছে ৩৫ গোল, অ্যাওয়েতে ৩৩ গোল। লিগের তৃতীয় দল ট্রান্সপোর্ট ইউনাইটেডের কাছে হেরেছে ৮-৩ গোলে, শীর্ষ দল পারো এফসির কাছে ৭-০ গোলে।
রেভেন এফসির কেন এই অবস্থা? কারণটা শুনুন কোচ আজমলের মুখেই, ‘আমার খেলোয়াড়েরা ছিল একেবারেই কাঁচা। ফুটবল সম্পর্কে ওদের প্রাথমিক ধারণাগুলো খুবই দুর্বল। এমনও দেখেছি, কোন দিকে পাস দেবে, কোন দিকে বল নিয়ে শরীর ঘোরাবে—কিছুই বোঝে না। আমাকে ছয় মাস ধরে হাতে–কলমে এগুলো শেখাতে হয়েছে।’
আনকোরা খেলোয়াড় নিয়েও অনেক সময় কোচরা বাজিমাত করেন। আজমল সেটা না পারার কারণটাও বললেন, ‘এই পর্যায়ে যদি বল রিসিভিং শেখাতে হয়, আক্রমণে কীভাবে যেতে হয়, জায়গা কীভাবে তৈরি করতে হয়, ফরমেশন কাকে বলে শেখাতে হয়, তাহলে কীভাবে হবে? বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৩ বা ১৪ বছরের ছেলেদের এগুলো আমরা শেখাই। পাইওনিয়ারের ফুটবলাররাও এসব জানে।’
তারা ভালো খেলোয়াড় নিতে পারেনি। এএফসি এ লাইসেন্সধারী একজন কোচ দরকার, সে কারণেই তারা আমাকে নিয়েছে। সেটাও দল গড়ার পর। আজমল হোসেন
ভুটানে বেশির ভাগ তরুণ ফুটবলার সারা দিন ফুটসাল খেলেন। সেখানে একটু ভালো খেলে প্রিমিয়ারে চলে আসেন। তবে আনকোরাদের ঠাঁই হয় আসলে পেছনের দিকের দলে। এটা সব দেশের ফুটবলেই হয়। বাংলাদেশে আজমপুর উত্তরা প্রিমিয়ারে উঠে দল গড়েছে অখ্যাত নবীনদের নিয়ে। ভুটানের থিম্পু রেভেন এফসির ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে। পাঁচজন বিদেশি ছিলেন দলে, চারজন খেলতে পেরেছেন ম্যাচে। দুজন করে নাইজেরিয়া ও ভারতের এবং একজন ঘানার ফুটবলার। শীর্ষ লিগে খেলতে যে অভিজ্ঞতা দরকার, স্থানীয়দের সেটা ছিল না। ‘তারপরও এই ১০ পয়েন্টও পেয়েছি ফুটবলারদের বাসা থেকে ফোন করে করে অনুশীলনে এনে’—আজমল ফিরে তাকান তাঁর ভুটান অধ্যায়ে।
আধা অপেশাদার ফুটবলে একটি ছোট দলে এমনটা হওয়া অবশ্য বিচিত্র নয়। ফুটবলারদের সঙ্গে ক্লাবের পেশাদার চুক্তি নেই। এর ফলে তাল কাটা স্বাভাবিকই। আজমল যেমন বলেছেন, ‘ক্যাম্প হয় অনাবাসিক। সকালে অনুশীলন দিলে ওরা আসতে চায় না। অনেকে পার্টি করে গভীর রাতে ঘুমায়। যখন মন চায়, অনুশীলনে আসে। এমনও হয়েছে, মাত্র পাঁচজন খেলোয়াড় নিয়ে অনুশীলন করেছি।’ অনুশীলনে এলেও কোচ সমস্যা দেখেছেন আরেকটা, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলোয়াড়েরা কোচের কথা শুনতে চায় না। ওরা মনে করে, ওরা অনেক ভালো খেলে।’
যে ম্যাচগুলোয় কোচের কথামতো খেলতে পেরেছেন খেলোয়াড়েরা, সেগুলোই নাকি জিতেছে রেভেন এফসি। কোচের ভাষ্যমতে, বাকি ম্যাচগুলো নিজেদের মতো খেলে গেছে ওরা। বাংলাদেশে পাইওনিয়ার পর্যায়ে ছেলেরা যেমন থাকে, আজমলের দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড় নাকি তেমনই ছিলেন। তিনজন ছিল স্কুল দলের খেলোয়াড়। স্কুলের পরীক্ষার সময় তারা আসতে পারেনি অনুশীলনে। চোট আছেই, থাকে এটা-ওটা অজুহাতও। কথায়–কথায় আজমল জানান, ভুটানের ফুটবলে সুযোগ–সুবিধার অভাব। রেভেন এফসির অনুশীলনে নাকি অনেক সময় পানিও পাননি।
নিশ্চয়ই এটা ভুটানের সামগ্রিক ফুটবলের চিত্র নয়। তাহলে লিগের শীর্ষ দল পারো এফসি ১৮ ম্যাচে ১৬টিই জিতে ৪৯ পয়েন্ট পায় কীভাবে? আসলে দলের মধ্যে রকমফের আছে। আজমল গিয়ে পড়েছেন এমন এক দলে, যাদের সামর্থ্য কম। পেশাদার কাঠামোও নেই।
রেভেন এফসি ২৫ বছর পর ভুটানের শীর্ষ লিগে খেলেছে এবার। কিন্তু ফেরাটা আনন্দময় হয়নি। না হওয়ার কারণটা বলেন আজমল, ‘তারা ভালো খেলোয়াড় নিতে পারেনি। খেলোয়াড় নির্বাচনের দায়িত্বটা থাকা উচিত কোচের ওপর। কিন্তু আমি তো আর দল গড়িনি। এএফসি এ লাইসেন্সধারী একজন কোচ দরকার, সে কারণেই তারা আমাকে নিয়েছে। সেটাও দল গড়ার পর।’
ভুটানে ঘাসের মাঠের অভাবে কৃত্রিম মাঠ গড়ে উঠেছে তিনটি, যার মধ্যে আছে চাংলিমাথান স্টেডিয়াম, থিম্পু রয়েল ফুটবল মাঠ, উগান একাডেমি মাঠ। এসব মাঠে হয়েছে লিগের ম্যাচগুলো। স্কুলের মাঠ থাকলেও ঘাস নেই, লাল মাটি। এর ফলে সেখানে প্রাকৃতিক মাঠের সঙ্গে কম পরিচয় হয় হবু ফুটবলারদের। তরুণদের ফুটবলে আকৃষ্ট করার মতো অর্থও নেই ভুটানে।
বাংলাদেশে মাঝারি মানের একজন খেলোয়াড় কম করেও এক মৌসুমে ২৫-৩০ লাখ টাক পান ক্লাব থেকে। আর ভুটানের প্রিমিয়ার লিগের একটা দলের বাজেটই বছরে বড়জোড় ২৫ লাখ রুপি। ভুটানের এক রুপির সমান বাংলাদেশের ১ দশমিক ৩২ টাকা। ভুটানে পুরো মৌসুমের জন্য বড় চুক্তি হয় না। ফুটবলারদের নেওয়া হয় মাসিক বেতনে।
আজমল বলেন, ‘আমার টিমের খেলোয়াড়েরা মাসে বেতন পেয়েছে সর্বোচ্চ ৮-১০ হাজার রুপি, সর্বনিম্ন ৫ হাজার রুপি। বাংলাদেশের গ্রামের ছেলেরা খেপ খেললেই পাঁচ হাজার টাকা পায়। মাস গেলে ৭ তারিখে বেতন দেওয়ার কথা, দিতে দিতে ২০ তারিখ হয়ে যায়। এর ফলে খেলোয়াড়েরা অনুশীলনে আসতে চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক।’
আজমল জানান, রেভেন এফসির তিন আফ্রিকান পেয়েছেন মাসে ২০ হাজার রুপি করে। দুই ভারতীয় ১০ হাজার করে। অথচ বাংলাদেশের মাঝারি মানের ফুটবলারের মাসিক বেতন পড়ে তিন-চার লাখ টাকা। শীর্ষ ফুটবলাররা মাসে পান ৮-৯ লাখ টাকা। ভুটানে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া ফুটবলারের মাসিক বেতনই ২০-২৫ হাজার রুপি। তারপরও আজমলের চোখে পড়েছে উইংয়ে একজন ভুটানিজ খেলোয়াড়। এ বছর তিনি থাইল্যান্ডে যাবেন খেলতে। দেশটির ফুটবলে সবচেয়ে বড় তারকা চেনচো বাংলাদেশের লিগে খেলে গেছেন।
থিম্পুতে জনসংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার। আমাদের নারায়ণগঞ্জে ভোটারই সাড়ে পাঁচ লাখ। থিম্পুর মানুষজন এত কম যে সবাই সবাইকে চেনে আজমল হোসেন
ভুটানের ফুটবলে স্পনসরের অভাব। মাত্র তিন–চারটি ব্যাংক। ব্যাংক অব ভুটান স্থানীয় লিগ স্পনসর করেছে। স্পনসর প্রতিষ্ঠান যে অংশগ্রহণ ফি দিয়েছে একেকটি দলকে, সেই টাকা দিয়েই তারা দল বানিয়ে ফেলে। তিন লাখ করে পেয়েছে প্রতিটি দল। লিগে একটামাত্র দলের স্পনসর আছে, দ্রুক এয়ারলাইনস। তুলনায় বাংলাদেশের ফুটবলে পৃষ্ঠপোষক অনেক। অথচ ফিফার তালিকায় সেটার প্রতিফলন নেই। যেখানে ভুটান ১৮৪, বাংলাদেশ ১৮৩। আজমল মনে করেন, ভুটানের থাকা উচিত আসলে সবার শেষে (২১০)।
সেই ভুটান তাহলে বাংলাদেশকে বয়সভিত্তিক ফুটবলে হারায় কীভাবে? ২০১৬ সালে এই ভুটানের কাছে হেরেই প্রায় দুই বছর আন্তর্জাতিক ফুটবলের বাইরে ছিল বাংলাদেশ জাতীয় দল! সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? আজমল বলেন, ‘হোম ম্যাচে ওদের হারানো আসলে অনেক কঠিন। ওরা টার্ফে ভালো খেলে। এর উদাহরণ হলো সর্বশেষ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে হংকংয়ে গিয়ে ভুটান হেরে এসেছে ৪-০ গোলে। যখন ভুটানের মাঠে খেলা হয়েছে, ভুটান ২-০ গোলে জিতেছে। তিনটা বল বারে লেগেছে। ৫-০ হলে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠত ভুটান। ওদের মাঠে গিয়ে এখন বাংলাদেশ জিততে পারবে না, আমার ধারণা।’
ভুটান ছোট্ট একটা দেশ। বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। পাহাড়ঘেরা দেশটির জনসংখ্যা মাত্র আট লাখের মতো। ভুটানে ছয় মাস কাটিয়ে আসার অভিজ্ঞতায় আজমল মজা করে বললেন, ‘সব জিনিসপত্র তো আসলে ভারতেরই। ভারতের মুদ্রা চলে সেখানে। থিম্পুতে জনসংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার। আমাদের নারায়ণগঞ্জে ভোটারই সাড়ে পাঁচ লাখ। থিম্পুর মানুষজন এত কম যে সবাই সবাইকে চেনে।’
আজমলকেও চিনেছেন অনেকে!