দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে আওয়ামী লীগ। এজন্য কৃষি উন্নয়নে জোর দেয়ার কথা বলছে দলটি।
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে বেলা ১১টার কিছু পর থেকে ইশতেহার ঘোষণা শুরু করেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।
‘সবার জন্য খাদ্য’ এই অঙ্গীকারকে সামনে রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের ইশতেহারে কৃষির উন্নয়নে জোর দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জনগণের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি। এ দেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে, শিল্পের কাঁচামাল জোগানে ও রফতানি আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে কৃষির। তাই স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষিবিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারও রাষ্ট্র পরিচালনায় কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চালের উৎপাদন সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বর্তমানে ধান, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এছাড়া পাট উৎপাদনে ২য়, চা উৎপাদনে ৪র্থ এবং আলু উৎপাদনে ৭ম অবস্থানে আমাদের দেশ। দেশি-বিদেশি ফল আবাদেও অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে বেশ। কফি, কাজুবাদাম, গোলমরিচ, মাল্টা, ড্রাগনসহ অপ্রচলিত কিন্তু লাভজনক বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদে উৎসাহিত করা হচ্ছে কৃষকদের। ২০০৬ সালে মাথাপিছু ফল গ্রহণের হার যেখানে ছিল ৫৫ গ্রাম, ১৫ বছরে তা বেড়ে ২০২৩ সালে হয়েছে ৮৫ গ্রাম। ১৫ বছরে দেশে উদ্ভাবিত হয়েছে ৬৯৯টি বৈরী পরিবেশে সহনশীল, উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল এবং প্রায় ৭০৮টি প্রযুক্তি।
এ ছাড়া যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিকায়ন করার কাজ চলছে। ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে কৃষকদের মাঝে। তিন হাজার কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলমান আছে। সব মিলিয়ে দেশের কৃষিব্যবস্থা ‘জীবন নির্বাহী’ কৃষি থেকে ‘বাণিজ্যিক কৃষি’তে রূপান্তরিত হচ্ছে।
এই ধারা অক্ষুন্ন রাখতে এবার ইশতেহারে পরিকল্পনার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন কৌশল অনুসরণের অঙ্গীকার করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ, সবার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসম্মত খাদ্য সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশ, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, কৃষি ও অকৃষিজ পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এই কৌশলের লক্ষ্য। বরাবরের মতো বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে এবারো।
ইশতেহারে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার
‘সবার জন্য খাদ্য’ আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য ও অঙ্গীকার। কৃষি, কৃষক-কৃষাণী ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন কৌশল অনুসরণের ধারা অব্যাহত থাকবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ, সব মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসম্মত খাদ্য সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশ, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, কৃষি ও অকৃষিজ পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এই কৌশলের লক্ষ্য। বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গৃহীত কর্মসূচি আগামী দিনে আরও সম্প্রসারিত হবে বলে অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধুকন্যার। কৃষিঋণ সহজলভ্য ও সহজগম্য করার লক্ষ্যে ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদে কৃষিঋণ দেয়া অব্যাহত থাকবে; কেন্দ্রীয় ব্যাংক শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে পুনঃঅর্থায়ন করবে। ফলে কৃষিঋণ বিতরণে আরও উৎসাহিত হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এছাড়া কৃষির জন্য সহায়তা ও ভর্তুকি তথা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণে বিনিয়োগ সহায়তা অব্যাহত রাখবে আওয়ামী লীগ। সেইসঙ্গে কৃষিতে শ্রমিকসংকট লাঘব এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহজে ব্যবহারযোগ্য কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য করা হবে। ভর্তুকি দেয়া অব্যাহত থাকবে কৃষি যন্ত্রপাতিতে।
আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যেই কৃষি উৎপাদন আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব জমি আবাদের আওতায় আনার নীতি বাস্তবায়ন করছে। শেখ হাসিনার অঙ্গীকার, কোনো জমিই অনাবাদি থাকবে না। সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলায় গুরুত্বারোপ করা হবে।
শুধু তাই নয়, স্মার্ট কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো-টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষির আধুনিকায়ন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ অব্যাহত থাকবে। সেইসঙ্গে কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, রফতানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ সর্বোপরি আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের গুরুত্বও অপরিসীম। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর প্রাণিজ চাহিদা পূরণে উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান তৈরি ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখার লক্ষ্যে তাই মৎস্য ও গবাদি পশুখাতেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। এই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের এবারের অঙ্গীকার-
১. ২০২৮ সালের মধ্যে গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা দেড় গুণ বৃদ্ধি করা হবে।
২. বাণিজ্যিক দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খামার প্রতিষ্ঠা, আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনীয় ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দেয়া হবে।
৩. গুণগত মানসম্পন্ন পশুখাদ্য উপকরণের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তির প্রসার ও যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করা হবে।
৪. উৎপাদিত প্রাণিজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিমুখী শিল্পের প্রসার করা হবে।
৫. ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে বাণিজ্যিক খামার ম্যাকানাইজেশন ও স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা হবে।
৬. সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারপূর্বক খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে টেকসই মৎস্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন ৪৯ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন থেকে ৫৮ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করা হবে এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে জনপ্রতি মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬৭ দশমিক ৮০ গ্রাম/দিন থেকে বৃদ্ধি করে ৭৫ গ্রাম/দিনে উন্নীত করা হবে।
৭. সুনীল অর্থনীতির বিকাশ সাধনে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ ও দায়িত্বশীল মৎস্য আহরণ নিশ্চিত করা হবে।
৮. জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, অভিযোজন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ডেল্টা হটস্পটভিত্তিক প্রকল্প/কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
৯. ভ্যালু চেইন উন্নয়নের মাধ্যমে মৎস্যসম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, বৈচিত্র্যময় ভ্যালু অ্যাডেড মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মৎস্য অপচয় ১০ শতাংশ হ্রাস করা হবে এবং এ খাতে আগামী ৫ বছরে প্রায় ৬ লাখ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে।
১০. মৎস্য ও মৎস্যপণ্য রফতানি বৃদ্ধিতে রফতানিমুখী মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ করা হবে; দেশের বাইরে নতুন নতুন বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আমদানিকারক উদ্বুদ্ধকরণে ফিশ এক্সপো আয়োজন এবং মৎস্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রফতানি আয় ৪ হাজার ৭৯০ কোটি থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হবে।
১১. প্রাণিসম্পদ-গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চলমান কর্মসূচিকে বিস্তৃত করা হবে। এসব পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও মূল্য সংযোজনের লক্ষ্যে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে।
১২. পুকুরে মাছ চাষ এবং যেখানে সম্ভব ধানক্ষেতে মাছ চাষের আরও প্রসারের জন্য উন্নত জাতের পোনা, খাবার, রোগব্যাধির চিকিৎসা অব্যাহত রাখা হবে।
১৩. খামারিদের জন্য সুলভে পুঁজিসংস্থান ও বিদ্যুৎ-সংযোগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া অব্যাহত রাখা হবে।