কাতার বিশ্বকাপে অন্যতম ফেবারিট হিসেবে অংশ নিলেও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ হয় ব্রাজিলের। হেক্সার অপেক্ষা দীর্ঘ হওয়ার পর পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা চলতি বছর নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছিল। তবে বছরটা ভালো কাটেনি নেইমার-ভিনিসিউসদের। স্থায়ী কোচের পদ ফাঁকা থাকা, নেইমারের ইনজুরি, তারকাদের ক্লাবের ফর্ম জাতীয় দলে টেনে আনতে না পারাসহ নানা কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারেনি ফুটবল ইতিহাসের সফলতম দলটি।
কোপা আমেরিকার আর ছয় মাসের একটু বেশি থাকলেও এখনও ব্রাজিলের কোচ নিয়ে জটিলতা কাটেনি। চলতি বছর বেশকটি ম্যাচ হেরে র্যাঙ্কিংয়ে অবনতি হয়েছে সেলেসাওদের। এর মধ্যে আছে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে লজ্জার হারও।
কোচ নিয়ে জটিলতা
কাতার বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় কোচ নিয়োগের ঐতিহ্য থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়ে ২০২৩ সাল শুরু করে ব্রাজিল। জিনেদিন জিদান, পেপ গার্দিওলা ও কার্লো আনচেলত্তির মতো ক্লাব ফুটবলের কিংবদন্তি কোচের ব্রাজিলের দায়িত্ব নেয়ার গুঞ্জন শোনা গেছে সারা বছর।
এর মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান কোচ কার্লো আনচেলত্তিকে ঘিরে গুঞ্জন সবচেয়ে জোরালো। রিয়ালের সঙ্গে ২০২৪ সালের জুনে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই ব্রাজিলের দায়িত্ব নেবেন আনচেলত্তি। যদিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত খোলাখুলি কিছু বলেননি তিনি। রিয়ালের সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে এ ইতালিয়ান কোচ নতুন চুক্তির বিষয়ে খোলামেলাভাবেই দর কষাকষি করতে পারবেন।
কাতার বিশ্বকাপের পর এখন পর্যন্ত দুজন ব্রাজিলিয়ান কোচের অধীনে খেলেছে ব্রাজিল। ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে ব্রাজিলের যুবদলের কোচ রামোন মেনেজেস তিনটি ম্যাচে ডাগআউট সামলেছেন। বিশ্বকাপের পর মরক্কোর বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলে ব্রাজিল। এরপর তার অধীনে গিনি ও সেনেগালের বিপক্ষেও খেলেছে সেলেসাওরা। তার অধীনে তিন ম্যাচের দুটিতেই হেরেছে ব্রাজিল।
মেনেজেসের পর এখন ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে ব্রাজিলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ফ্লুমিনেন্সের কোচ ফার্নান্দো দিনিজ। তার অধীনে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের পাঁচটি ম্যাচ খেলে দুটি করে জয় ও পরাজয়ের পাশাপাশি একটি ম্যাচ ড্র করেছে ব্রাজিল।
পরাজয়ের বৃত্তবন্দি ব্রাজিল
চলতি বছরটা ব্রাজিল নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। চলতি বছর বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচ ও প্রীতি ম্যাচ মিলিয়ে ৯টি ম্যাচ খেলে মাত্র ৩টিতে জয় পেয়েছে ব্রাজিল। হেরেছে পাঁচটিতে। আর বাকি এক ম্যাচে ড্র করেছে।
কাতার বিশ্বকাপের পর মরক্কোর বিপক্ষে প্রথম মাঠে নামে সেলেসাওরা। সেই প্রীতি ম্যাচে প্রথমবারের মতো মরক্কোর বিপক্ষে হারে ব্রাজিল। ম্যাচটি ১-২ ব্যবধানে হারে রদ্রিগো-ভিনিসিউসরা।
চলতি বছর প্রথমবারের মতো সেনেগালের বিপক্ষে হেরেছে ব্রাজিল। ছবি: সংগৃহীত
এরপর গিনিকে ৪-১ ব্যবধানে হারালেও আরেক প্রীতি ম্যাচে প্রথমবারের মতো সেনেগালের বিপক্ষে হারের মুখ দেখে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। ২-৪ গোলে ম্যাচটি হারে ব্রাজিল।
এরপর ২০২৬ বিশ্বকাপের দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বাছাই পর্বে প্রথম দুই ম্যাচে জয় পেয়ে শুভসূচনা করেছিল ব্রাজিল। প্রথম ম্যাচে ভেনেজুয়েলাকে ৫-১ ও পেরুকে ১-০ গোলে হারানোর পর তৃতীয় ম্যাচে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে।
তবে এর পরেই খেই হারায় তারা। পরের তিন ম্যাচে টানা হারের মুখ দেখে ব্রাজিল। উরুগুয়ের বিপক্ষে ০-২ গোলে হারের পর কলম্বিয়ার বিপক্ষেও ১-২ গোলে হারের মুখ দেখে। বাছাই পর্বে এই প্রথমবার কলম্বিয়া হারিয়েছে ব্রাজিলকে। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় এর পরের ম্যাচেই। ঘরের মাঠে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে হারের মুখ দেখে ব্রাজিল। তাও আবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। মারাকানা স্টেডিয়ামে নিকলাস ওতামেন্ডির একমাত্র গোলে আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে হারায়।
এ ম্যাচ চলাকালীন আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়ায় ব্রাজিলের সমর্থকরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তারক্ষীরা বল প্রয়োগে বাধ্য হয়। এর এক পর্যায়ে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের ওপর লাঠিচার্জের প্রতিবাদে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসি দল নিয়ে ড্রেসিং রুমে চলে যান। কিছুক্ষণ বিরতির পর ফের খেলা মাঠে গড়ায়।
বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বাছাই পর্বে ৬ ম্যাচ শেষে ২ জয় ও ১ ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট নিয়ে ৬ নম্বরে আছে ব্রাজিল। সরাসরি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে বাছাই পর্বের সেরা ৬-এ থেকে শেষ করতে হবে ব্রাজিলকে।
র্যাঙ্কিংয়ে অধঃপতন
বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিলেও ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থানে থেকেই বছর শুরু করেছিল ব্রাজিল। কিন্তু এপ্রিলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার কাছে শীর্ষস্থান হারায় তারা। দুই ধাপ পিছিয়ে তিনে নেমে যায় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।
তবে চলতি বছরের বাজে পারফরম্যান্সে সেরা তিনেও জায়গা ধরে রাখতে পারেনি সেলেসাওরা। গত ৩০ নভেম্বর র্যাঙ্কিংয়ে আরও দুই ধাপ অবনমন হয় ব্রাজিলের। আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও বেলজিয়ামের পেছেন পাঁচ নম্বরে নেমে যায় সবচেয়ে বেশিদিন শীর্ষে থাকার রেকর্ডের মালিকরা। ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত বছরের শেষ হালনাগাদ র্যাঙ্কিংয়েও উন্নতি করতে পারেনি ব্রাজিল। পাঁচে থেকেই বছর শেষ করেছে নেইমার-ভিনিসিউসরা।
পেলেকে ছাড়িয়ে নেইমার
কাতার বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে ৭৭তম গোলটি করেছিলেন নেইমার। ব্রিটিশ সাংবাদিক মাইকেল কক্স যে গোলটিকে বলেছিলেন, ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ভাস্বর গোল। সেই গোলেই ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোল করা পেলেকে ছুঁয়েছিলেন নেইমার। কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ঘণ্টা বেজে যাওয়ায় আর পেলেকে ছাড়িয়ে যাওয়া হয়নি তার।
পেলেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেইমারের সামনে আসে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে। এদিনই চলতি বছর প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের জার্সিতে নেমেছিলেন নেইমার। আর নেমেই ইতিহাস রচনা করেছেন। বলিভিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের সে ম্যাচে ৫-১ গোলে জয় পায় ব্রাজিল। দলের বড় জয়ের দিনে জোড়া গোল করেন নেইমার। ৬১ মিনিটে ব্যক্তিগত প্রথম গোলটি করেই তিনি ছাড়িয়ে যান গত ডিসেম্বরে প্রয়াত হওয়া পেলেকে। এই গোলটি করেই তিনি পেলের ট্রেডমার্ক উদযাপনে প্রয়াত কিংবদন্তিকে শ্রদ্ধা জানান। এরপর যোগ করা সময়ে আরও এক গোল করেন নেইমার। ১২৫তম ম্যাচে পেলের রেকর্ড ভাঙেন নেইমার। এরপর বাছাই পর্বে উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ইনজুরিতে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন তিনি। এই ইনজুরিতে কোপা আমেরিকা থেকে ছিটকে গেছেন নেইমার।
সর্বোচ্চ গোল
চলতি বছর ব্রাজিলের জার্সিতে সর্বোচ্চ গোল করেছেন রদ্রিগো। রিয়াল মাদ্রিদের এই উইঙ্গার ৩ গোল করেছেন। এর পরেই আছেন ২ গোল করে করা নেইমার, মার্কুইনিয়োস।
অভিষেক হওয়া উল্লেখযোগ্য তারকা
চলতি বছর ব্রাজিলের জার্সিতে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের অভিষেক হয়েছে। এ তালিকায় আছেন এনদ্রিক ও ভিতর রোকের মতো উদীয়মান তরুণ খেলোয়াড়। দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন রোনালদো নাজারিওর পর সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে কলম্বিয়ার বিপক্ষে অভিষেক হয় এনদ্রিকের। এছাড়া ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেক হয়েছে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের মিডফিল্ডার জোয়েলিংটনেরও।
ব্রাজিলিয়ান লিগ থেকে সান্তোসের অবনমন
চলতি বছরে ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলের সবচেয়ে বড় অঘটন সান্তোসের অবনমন। সিরি আ’র শেষ দিনে ফোর্তলেজার বিপক্ষে ১-২ গোলে হেরে আগামী মৌসুমের জন্য শীর্ষ লিগ থেকে অবনমিত হয়ে যায় এ দলটি। ব্রাজিলের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্লাব সান্তোস। এ ক্লাবের হয়ে খেলেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন ফুটবলসম্রাট পেলে। এটি নেইমারেরও সাবেক ক্লাব। এ ক্লাবের বিখ্যাত ফুটবলারের তালিকায় আছেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিভাবান তারকা রদ্রিগোও।
সিরি আ’ থেকে অবনমিত হওয়ার পর ক্লাবটি প্রয়াত পেলের প্রতি সম্মান জানিয়ে সাময়িকভাবে ১০ নম্বর জার্সি তুলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে। ফের যখন সান্তোস সিরি আ’য় উঠে আসবে, ফের ১০ নম্বর জার্সি মাঠে দেখা যাবে।