শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে অনেকাংশেই ছোট। এছাড়া বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির কাঠামো একেবারেই আলাদা। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থা তুলনীয় নয়। তবে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তারা যেভাবে বড় সমস্যা মোকাবিলা করে এখন স্থিতিশীল হচ্ছে সেটাই শিক্ষণীয় বিষয়। আসলে অর্থনীতির মূল বিষয় হলো সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। আমাদের যে সম্পদ রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না
শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি বৃহৎ দ্বীপ রাষ্ট্র। আগে দেশটি সিলন (ঈবুষড়হ) নামে পরিচিত ছিল। পরে নামকরণ করা হয় শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা শব্দটি এসেছে সংস্কৃতি শব্দ শ্রী ও লঙ্কা থেকে। শ্রী শব্দের অর্থ পবিত্র এবং লঙ্কা শব্দের অর্থ দ্বীপ। বর্তমানে এটি সরকারিভাবে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী শ্রীলঙ্কা (উবসড়পৎধঃরপ ঝড়পরধষরংঃ জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ঝৎর খধহশধ) নামে পরিচিত। দেশটির প্রশাসনিক রাজধানী শ্রী জয়বর্ধেনেপুর কোট্টে হলেও বৃহত্তম শহর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র কলম্বো। প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক সৈকত ও বাণিজ্য কেন্দ্র। দ্বীপ রাষ্ট্রটির বিলাসদ্রব্য ও মসলার ব্যবসা বহু দেশের ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করে, যা শ্রীলঙ্কার বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যা তৈরি করতে সাহায্য করে। এসব দেখে এ দ্বীপ রাষ্ট্রটি এক সময় ব্রিটিশরা দখল করে নেয় এবং ধীরে ধীরে দ্বীপের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করে। পরবর্তীতে এক সময় দেশটি স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আন্দোলন শুরু হলে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
শ্রীলঙ্কা একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতিসত্তার আবাসস্থল। সিংহল জাতি একটি বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলেও তামিল টাইগাররা প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে আসছিল। তাই স্বাধীনতার পরপরই দেশটিতে আধিপত্য বজায় রাখার লক্ষ্যে সিংহল ও তামিলদের মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ফলে দেশটির প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি শ্রীমাভো বন্দের নায়েক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
তিনি ছিলেন ওই সময় সারা পৃথিবীর প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তার সময়ই এ দ্বীপ রাষ্ট্রটির নাম সিলন থেকে শ্রীলঙ্কা করা হয়, যা বর্তমানে সার্বভৌম ও স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী শ্রীলঙ্কা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বন্দের নায়েকের প্রধান কাজ হয় গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপ এবং বিরোধী তামিল নেতার মৃত্যুর পর শ্রীলঙ্কার জাতিগত অস্থিরতা ও সহিংসতা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে যায়।
চা, কফি, নারিকেল ও রাবার উৎপাদনে দেশটির রয়েছে বিশ্বখ্যাতি। খাবার সুস্বাদু করতে গেলে মসলার জুড়ি নেই। শ্রীলঙ্কায় হয়ে থাকে নানা ধরনের দুর্লভ মসলার চাষ। বিশেষ করে সে দেশের দারুচিনির সুখ্যাতি পৃথিবীজুড়ে। এজন্য অনেকে শ্রীলঙ্কাকে ‘স্পাইস আইল্যান্ড’ও বলে থাকে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত সমুদ্র সৈকত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে শ্রীলঙ্কা একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় দেশ। স্বাধীনতার সময় জনসংখ্যা ছিল এক কোটির কাছাকাছি। যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৭ লাখ ৭৬ হাজারে। বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাকিরা হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। মানুষ প্রায় শতভাগ শিক্ষিত। শিশুদের ৯ বছর বয়স থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক।
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। তিনি নির্বাচিত হন ছয় বছরের জন্য। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রতিটি জেলা থেকে সংসদ সদস্যরা সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত হন। ২০২২ সালের শুরুতেই শ্রীলঙ্কা তার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়। দেশটির অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় মানুষের আয় সঙ্কুুচিত হয়ে পড়ে এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পায়। মূল্যস্ফীতি গিয়ে দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশে। সংকটে বিপর্যস্ত দেশটিতে বিদ্যুতের বিরামহীন অভাব দেখা দেয়। জ্বালানির মজুত ফুরিয়ে আসে। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র জনরোষ। এক পর্যায়ে জনগণ সাবেক রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকশের সরকারি বাসভবনে চড়াও হলে তীব্র ক্ষোভের মুখে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা কিন্তু রাতারাতি তৈরি হয়নি। অনেক দিন থেকেই ধীরে ধীরে এ সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা তার বেশিরভাগ ওষুধ বাইরে থেকে আমদানি করে থাকে। কাজেই অর্থনৈতিক সংকট যখন শুরু হয় তখন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধেরও ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। অথচ দেশটির তলানিতে থাকা সামান্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় দিয়ে তারা জরুরি ওষুধ না খাদ্যসামগ্রী আমদানি করবে এই সিদ্ধান্তটুকু পর্যন্ত নিতে পারছিল না। খাবার জোগাড়ে দেশটি হিমশিম খেতে থাকে। যে কাঁঠালকে তারা এক সময় খাবার হিসেবে অবজ্ঞা করত সেই কাঁঠাল খেয়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচে। এই কাঁঠালই ওই সময় প্রাণ রক্ষাকারী আহার হয়ে দাঁড়ায়।
এই সংকটময় পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য সংসদ সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে রনিল বিক্রমাসিংহেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করেন। তখন রাষ্ট্র্রপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ দীনেশ গুন বর্ধনকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেন, যিনি রাষ্ট্রপতির ডেপুটি হিসেবে কাজ করবেন। উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকা গণবিক্ষোভ আর অর্থনৈতিক ধস থেকে দেশকে বের করে আনার জন্য রনিল বিক্রমাসিংহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ দায়িত্ব নেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কা আসলে বহু দিক থেকেই এগিয়ে ছিল। দীর্ঘকাল ধরে গৃহযুদ্ধ- সংঘাত থাকলেও শ্রীলঙ্কা মানব সূচক উন্নয়নে সব সময়ই ওপরে থেকেছে। দারিদ্র্যের হার, শিশুমৃত্যুর হার, শিক্ষার হার সবকিছুতেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক ভালো অবস্থানে ছিল। অথচ সেই শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটে দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষের জীবন তছনছ হয়ে যায়। বিদেশী ঋণের উচ্চাভিলাষী মেগা প্রকল্পগুলো যে ঠিকমতো বাছাই হয়নি, দেশের স্বার্থের অনুকূলে নয়, খরচও অনেক বেশি, প্রতি পদে পদে অনিয়ম তা পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়।
মাত্র দেড় বছর আগে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে যে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সরকারি ব্যয় কমানো, রাজস্ব আয় বাড়ানোসহ সংস্কারমূলক কার্যক্রমগুলো জোরদার করার ফলে দ্রুত ঘুরতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির চাকা। কেন্দ্রীয় বাংকের নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়ার পর সরকার তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশটির অর্থনীতিতে স্বাধীনভাবে নিজস্ব নীতি প্রণয়ন করছে। মূলত সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিগত পদক্ষেপের কারণে দেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতি পরিবর্তনে এক নাটকীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সাবেক রাষ্ট্রপ্রতি রাজাপাকশের সরকার একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেটি হলো তারা রাসায়নিক সার ব্যবহার করবে না। রাসায়নিক সার আমদানি করবে না, তারা অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন করবে জৈব সার ব্যবহার করে। এই নীতি গ্রহণ করার কারণে তাদের উৎপাদন অবিশ্বাস্যভাবে কমে যায়। পরবর্তীতে নতুন সরকার এসে আবার সার, বীজ আমদানি করে উচ্চ ফলনশীল ধান থেকে শুরু করে সবকিছু উৎপাদন শুরু করে। যে কারণে এই দেড়-দুই বছরের মধ্যে তাদের উৎপাদন আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে। অর্থাৎ, আগের ভুল নীতি থেকে সরে আসার ফলে কৃষি খাতও ভালো করতে শুরু করছে।
এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম পর্যটন খাতকে তারা চাঙা করেছে। প্রবাসী আয় বাড়ানো ও মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার মাধ্যমে তারা রিজার্ভ বাড়াচ্ছে। শ্রমশক্তি খাতকেও ঢেলে সাজিয়েছে। চিকিৎসক ও তথ্য প্রযুক্তিবিদদের মতো উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। ফলে দেশটির প্রবাসী আয় বেড়েছে। পাশাপাশি রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনার তারেক মো. আরিফুল ইসলামের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান যে, দেশটির অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে অর্থনীতি আবারও আগের ধারায় ফিরে আনতে পারবে। কিছু নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে খাদ্য ও ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল তা ক্রমেই স্বাভাবিক হচ্ছে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের ঋণও তারা ইতোমধ্যে পরিশোধ করে দিয়েছে।
এছাড়া আইএমএফ থেকে যে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে তার শর্ত মেনে কাজ করায় আইএমএফ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দেশ শ্রীলঙ্কা। তাই আর্থিক পুনরুদ্ধারে সবাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে নতুন করে কোনো বিদেশী ঋণ নয়, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি, সর্বোপরি সদিচ্ছা মূল ভূমিকা রেখেছে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে অনেকাংশেই ছোট। এছাড়া বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির কাঠামো একেবারেই আলাদা। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থা তুলনীয় নয়। তবে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তারা যেভাবে বড় সমস্যা মোকাবিলা করে এখন স্থিতিশীল হচ্ছে সেটাই শিক্ষণীয় বিষয়। আসলে অর্থনীতির মূল বিষয় হলো সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। আমাদের যে সম্পদ রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।
লেখক : চেয়ারম্যান, ব্যুরো বাংলাদেশ