সৌম্য সরকার : ১৬৯ রান। ভোরে যারা টেলিভিশন অন করেননি, সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখ কচলে এই স্কোর তাদের অনেককেই অবাক করেছে। সৌম্যকে দলে ডাকা হলেই যারা ফেসবুকের দেয়াল গরম করে তোলেন, একাদশে জায়গা পেলেই যারা কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের হাত রয়েছে বলে সন্দেহের বাষ্প তৈরি করেন, সৌম্য রান না পেলে যারা ট্রল করে তৃপ্তি পান– তাদের জন্য নেলসনে খেলা সৌম্যর এই রেকর্ড ছোঁয়া ইনিংসটা বিব্রতকরই ছিল বৈকি!
যে ছেলেকে নিয়ে অনায়াসেই মজা করা যেত, সেই কিনা ওয়ানডেতে দেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করল, তাও আবার বিদেশের মাঠে গিয়ে। এ যে বড্ড বেমানান! অগ্যতা সান্ত্বনা খোঁজা এই বলে, দল তো হেরেছে, তাছাড়া নিউজিল্যান্ডের দলটাইবা কী এমন ছিল– বোলাররা তো সবাই প্রায় নতুন। তা অবশ্য পুরোদমেই সত্যি– নেলসনের স্যাক্সটন ওভালে দল ২৯১ রান করেও ৭ উইকেটে হেরেছে। কিউই পেসার মিলনে, ডাফি, ও’রোওরকিরা তো আর সাউদি, বোল্ট, হেনরিদের মতো নন। কিন্তু এদিনও যদি সৌম্য রান না পেতেন তাহলে কী হতো তা বোধ হয় সহজেই আন্দাজ করা যায়। সৌম্য সরকারকে নিয়ে মিথ হয়ে যাওয়া কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক এবার।
প্রথমত : সৌম্য সরকার অনেক সুযোগ পেয়েছেন, আর কত?
আসলেই কি তাই– একটু পেছনে ফেরা যাক। ওয়ানডেতে ২০১৯ সালে সাকিব আল হাসান আর মুশফিকুর রহিমের পর ৫০৬ তুলে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহাকারী ছিলেন। সে বছর কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬৯ রান করেছিলেন। অথচ তার পরই লম্বা সময়ের জন্য বাদ পড়তে হয় তাঁকে। এর পর ২০২১ সালে ফেরানো হয়েছিল মাত্র ছয় ম্যাচের জন্য। সেখানেও তিনি চার ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে ৭, ০, ৩২ আর ১ রান পেয়েছিলেন। খেলানো হয়েছিল সাত আর তিন নম্বরে। সেই ম্যাচের পর দু’বছর বাইরে রাখা হয় তাঁকে।
এবার বিশ্বকাপের আগে আগে মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি ওয়ানডেতে ‘লিটমাস টেস্ট’ নেওয়া হয় তাঁর। সেখানে এক ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে কোনো রান করতে পারেননি– বিশ্বকাপে অচল বলে রায় নির্ধারিত হয়। বাকিরা যখন ব্যর্থ হয়, তখন আবারও ডাক পড়ে সৌম্যর। এ রকম ২০১৫ বিশ্বকাপের পরও বাদ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। মাঝে তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত– সব ব্যাটিং অর্ডারেই খেলানো হয়েছে। গেলো চার বছরে সাতটি ওয়ানডে খেলেছেন তিনি। হ্যাঁ, সুযোগ তিনি অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই পেয়েছেন বৈকি।
দ্বিতীয়ত, সৌম্যর মধ্যে কী এমন আছে? কেন তাঁকেই বারবার ডাকা হয়?
সত্যিই তো, সৌম্যর মধ্যে এমন কিইবা আছে। এর উত্তর দিতে পারবেন দলের কোচ এবং অধিনায়কই বেশি। কেননা, নির্বাচকদের বারবার উপেক্ষার পরও শুধু কোচ আর অধিনায়কের পছন্দেই ডাকা হয়েছে তাঁকে। তা তারা খুলে না বললে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া মুশকিল। তবে অন্যভাবে উত্তর খুঁজতে গেলে এটা বলা যায়, পাওয়ার প্লেতে সৌম্যর ব্যাটিংয়ে এমন কিছু আছে যা গত তিন বছরে অন্যদের মধ্যে হন্যে হয়ে খুঁজেও পাননি টিম ম্যানেজমেন্টের কেউ। এই বিশ্বকাপেই একজন হার্ডহিটার ওপেনারের অভাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
তৃতীয়ত, সৌম্য ধারাবাহিক না, এক ম্যাচে রান পাওয়ার পর আবার কবে বড় ইনিংস খেলবেন তা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়।
অভিযোগটা মোটেই অমূলক নয়। পাঁচ বছর পর ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি পেয়েছেন তিনি। সর্বশেষ সেই ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১১৭ রান করার ২৬ ইনিংস পর তৃতীয় এই সেঞ্চুরিটা পেয়েছেন। মাঝে পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরি পেলেও সঙ্গে ছিল ৯ বার এক অঙ্কের ইনিংসের লজ্জা। আসলে এখানেই নিজেকে শোধরাতে পারেননি বা শোধরানোর চেষ্টা করেননি। স্ট্রোক প্লেয়ার হিসেবে শুরু থেকেই শটস খেলার লোভ সামলাতে পারেন না তিনি। ঝুঁকি নিতে গিয়ে বারবার বিপদে পড়েছেন, তাও নিজেকে সেখান থেকে বের করতে পারেননি।
নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে এই ম্যাচেই যেমন ৯২ রানে থাকা অবস্থায় ছক্কা মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে জীবন পেয়েছিলেন। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে বিশ্বের নামিদামি ব্যাটাররাও ছাক্কা মারার ঝুঁকি নেন না, সেখানে সৌম্যর বিলাসিতা এখানেই। আর এভাবেই ৬৫ ম্যাচের ওডিআই ক্যারিয়ারে তাঁর ব্যাটিং গড় ৩৩.৩৯ আর স্ট্রাইকরেট ৯৮.১৭। এত অধারাবাহিকতার পরও আগামী তিন ইনিংসের মধ্যে ৬৩ রান করলে বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে দ্রুততম ২ হাজার রান হয়ে যাবে তাঁর।
চতুর্থত, হাথুরু কেন তাঁকে এত পছন্দ করেন?
ক্রিকেটাঙ্গনের প্রতিষ্ঠিত জনশ্রুতি কোচ হাথুরুসিংহের পছন্দের ক্রিকেটার তিনি। এই দাবি মিথ্যা বলা যাবে না। তবে কেন পুরোনো সেই সৌম্যকেই বারবার খোঁজেন লঙ্কান কোচ। উত্তর দিতে গিয়ে সৌম্য বলেছেন, ‘হয়তোবা তিনি আমাকে ভালো বোঝেন। একটা মানুষ হেঁটে গেলে তার মধ্যে অনেক নেগেটিভিটি পাবেন। আপনি যদি কেবল নেগেটিভিটি দেখতে চান, নেগেটিভিটিই দেখবেন। পজিটিভ চিন্তা করলে পজিটিভ জিনিস পাবেন। হয়তো তিনি পজিটিভ জিনিসটাই চিন্তা করেন।’
ভক্তকুল বা অভুক্তকুলরা যেখানে প্রতি ম্যাচেই তাঁর কাছে বড় ইনিংস চান, হাথুরু হয়তো সেভাবে তাঁর কাছ থেকে সেটা চান না। তিনি চান সৌম্য সেই আগের মতোই ওপেনিংয়ে নেমে বারুদের মতো শুরুটা করবেন। ২০১৫ বিশ্বকাপে যেমনটা করেছিলেন। সেখানে হয়তো সুদর্শন সেঞ্চুরি থাকবে না, হাফসেঞ্চুরিও থাকবে না– সেখানে হয়তো ২২ বলে ৪৫ রানের কোনো স্পার্ক থাকবে। যুদ্ধের কৌশলে ছোট-বড় সব ধরনেরই অস্ত্র দরকার। হাথুরুর কাছে সৌম্য হয়তো সেই কোনো সূক্ষ্ম অস্ত্র।
পঞ্চমত, আত্মবিশ্বাসের এত অভাব কেন?
এই যে নিউজিল্যান্ড সিরিজে দল ঘোষণার পর থেকেই সৌম্য সরকার কেন দলে দিয়ে আলোচনা শুরু। সংবাদ সম্মেলনে নাজমুল হোসেন শান্তর বলা, ‘সাকিবের বিকল্প’ দিয়ে ট্রল শুরু। প্রথম ম্যাচে শূন্য করার পর শুধু তাঁর কারণেই দল হেরেছে জাতীয় ফেসবুকের বিশেষজ্ঞদের মতামত। সব মিলিয়ে খারাপ সময়ে কিংবা সব সময়ই সমালোচনা আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছে।
খারাপ সময়ে ড্রেসিংরুম থেকে কতটা সমর্থন পেয়েছেন, তা না জেনে বলা যাচ্ছে না। তবে সৌম্যর অভিমান থাকতেই পারে– মিডিয়াকুল থেকে অন্যরা যতটা সমর্থন পেয়েছেন, ততটা তিনি পাননি বলে। চারপাশে এত নিন্দার পর শুধু ক্রিকেট ছাড়তে পারবেন না বলেই ক্রিকেট ছাড়েননি। ‘আমি তো খেলোয়াড়, আমাকে খেলতেই হবে। ভালো খেললে হয়তোবা ভালো নিয়ে লিখবেন, খারাপ করলে খারাপ নিয়ে লিখবেন।’ অনেক না বলা কথা ছিল তাঁর এই ১৬৯ রানের ইনিংসে।