ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে যিনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন তিনি বেগম রোকেয়া। বিদ্যাসাগর ধর্ম, বর্ণ, জাতির ঊর্ধ্বে ওঠে এ অঞ্চলে যুক্তিবাদ শিক্ষাধারার যে সূচনা করেছিলেন, বেগম রোকেয়াও সেই কাজটাই করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের রোকেয়া ইনস্টিটিউট অব ভ্যালু এডুকেশন এন্ড রিসার্চের আহ্বায়ক প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বুধবার (২০ ডিসেম্বর) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদভুক্ত দর্শন, ইতিহাস ও জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের আয়োজনে ‘রোকেয়ার জন্ম ও প্রয়াণ দিবস উদযাপন অনুষ্ঠান’ হয়। সেখানে রোকেয়া সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
চার পর্বের অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্বে তিনি বলেন, ‘ধর্মকে মনুষ্যত্বের পাথেয় মনে করতেন রোকেয়া। যেখানে মনুষ্যত্বের সংকট দেখতেন সেখানেই ধর্ম নিয়ে আসতেন। মনুষ্যত্বের সমাধান ছাড়া অন্য সবকিছু যৌক্তিক চিন্তায় সমাধান করতেন।’
আলোচক হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, ‘যখনই বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখন প্রায়শই পর্দার আলাপ করা হয়। রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’র যে পর্দার ধারণা তার সাথে যদি বর্তমানের পর্দার ধারণা গুলিয়ে ফেলেন, তাহলে তা ভীষণ রকমের সংকটজনক। পর্দার ধারণা অনেক বিস্তৃত। এমনকি ধর্মীয় আলোচনার ক্ষেত্রেও প্রায়ই অনেকে কোরআন শরীফের আয়াতের সূত্র দিয়ে পর্দার কথা বলেন। কিন্তু তারা এটা বলেন না যে, সূরা নূরে নারীর পাশাপাশি পুরুষদেরও চোখের পর্দা করার কথা বলা হয়েছে৷ তাই পর্দাকে শুধু নারীর সাথে যুক্ত করার রাজনীতি এটাই ছিল বেগম রোকেয়ার মূল আলোচনার ক্ষেত্র।’
‘পর্দাকে কেবল ধর্মীয় ডিসকোর্সের সাথে দেখা ভীষণ সমস্যাজনক। কারণ পর্দা কোনো একটি একক ধর্মীয় প্রতীকী উপস্থাপনা নয়। আপনি রাজস্থানে যান, সেখানেও লোকজনকে পর্দা করতে দেখবেন। পর্দার যে সংজ্ঞা তা কোন এক অদ্ভুত বা অযাচিত কারণে ৯/১১ এর পর পর্দার ধারণা আমাদের মধ্যে একপাক্ষিক ধর্মের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে।’
আলোচক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মন্ময় জাফর বলেন, ‘রোকেয়া আট-দশজন মানুষের থেকে আলাদা ছিল। রোকেয়ার ভাইয়েরা তাকে পড়াশোনা না শেখালে তখনকার সময়ের মুসলিম প্রজন্ম শিক্ষার বাইরে রয়ে যেত। রোকেয়া অপব্যয়ী ছিলেন না, ছিলেন জেদী। সে কারণে তার সময়কার উপনিবেশিক বাংলায় নারীশিক্ষায় ভূমিকা রাখেন। বিদ্যাসাগরের মতো রোকেয়াও ভারতীয় মুসলিমদের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর পাশাপাশি সমসাময়িক কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন। তিনি নারী মুক্তির যে সংগ্রাম করেছেন, তা থেকে তাকে কেউ বিচ্যুত করতে পারেনি।’
চার পর্বের অনুষ্ঠানের সবশেষ পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ। জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপার্সন রাকিব আহমেদের সঞ্চালনায় উপ-উপাচার্য বলেন, ‘কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র ১৯৪৮ সাল থেকে নারীদেরকে প্রথম সমাবর্তনের উপস্থিত হওয়ার সুযোগ দেয়, অথচ ১০০ বছর আগে ভারতবর্ষে বেগম রোকেয়া নারীদের শিক্ষা এবং সার্বিকভাবে নারী আধিপত্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন। এভাবেই পুরো একটা সমাজকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিলেন।’
চার পর্বের অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে আলোচক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, তৃতীয় পর্বে সভাপতি হিসেবে ছিলেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এমরান জাহান এবং প্রথম পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ টি এম নুরুল আমিনসহ প্রমুখ।