৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের পাশে আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। আজ স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের যে সাফল্য ও অর্জন, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে জাতিসংঘের বিশেষায়িত এই সংস্থার। আগামী দিনেও স্বাস্থ্য খাতের নানা ক্ষেত্রে সংস্থাটির সমর্থন ও সহায়তার দরকার আছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন।
‘বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা: ৫০ বছরের পথচলা’ শীর্ষক এই বৈঠক সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ে আয়োজিত হয়। অনুষ্ঠানের প্রচার সহযোগী ছিল ।
এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সংস্থাটি কাজ করছে ৫০ বছর ধরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই সংস্থার কর্মীরা শরণার্থীশিবিরে এ দেশের মানুষকে সেবা দিয়েছেন। গোলটেবিল বৈঠকে একাধিক বক্তা এসব প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। অনেকে নিজের অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার বিষয় তুলে ধরেন। কেউ কেউ কিছু সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবুল ফয়েজ ১৯৮১-৮২ সালে প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। বিভিন্ন ধরনের কাজে এ পর্যন্ত ৫২ বার জেনেভায় সংস্থাটির সদর দপ্তরে গেছেন। সংস্থার একাধিক কমিটিতে উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা তাঁর। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ কার্যালয় অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে কারিগরি সহায়তা দিয়ে চলেছে। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া, নিপাহ, বার্ড ফ্লু, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, করোনা এবং চিকিৎসাশিক্ষাসহ নানা বিষয়ে তারা সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশে দক্ষ স্বাস্থ্য জনসম্পদ তৈরিতেও ভূমিকা আছে তাদের।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরের প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা রিভিউ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করাসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, ৭১ বছর ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইনফ্লুয়েঞ্জার ওপর নজরদারি করছে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বর মাসে সারা বিশ্বের তথ্য পর্যালোচনা করা হয় এবং এর ভিত্তিতে টিকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।
সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগের সমালোচনা করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের উপদেষ্টা বা পরামর্শক হিসেবে বাছাই করে নিয়োগ দিত। এটাই ছিল রেওয়াজ। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য বলছে, এসব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে। এতে অনেকে মনে করছেন, বিশ্ব যোগ্য মানুষের কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য দেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা। এ রকম একটা অনুষ্ঠানের জন্য তিনি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, টিকা কার্যক্রম, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। পোলিও, কালাজ্বর, গোদরোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এসব কাজে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহায়তা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বর্ধন জং রানার বক্তব্যের পর অনুষ্ঠানে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হকের একটি ভিডিও বার্তা শোনানো হয়। তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বাংলাদেশ সফর করেছিলেন—এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রুহুল হক বলেন, বাংলাদেশ সব সময় সংস্থাটির সহযোগিতা পেয়েছে। সংস্থাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের নির্বাচিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
● বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ৫০ বছর ধরে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
● ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া, নিপাহ, বার্ড ফ্লু, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, করোনাসহ নানা বিষয়ে সহায়তা দিয়েছে সংস্থাটি।
● পোলিও, কালাজ্বর, গোদরোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ।
বৈঠকে স্বাস্থ্য বিভাগের তিনজন কর্মকর্তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ বলেন, রোগব্যাধির কারণে নরক হওয়া থেকে বিশ্বকে রক্ষা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা কার্যালয়, আঞ্চলিক কার্যালয় ও জেনেভার কেন্দ্রীয় কার্যালয় সব সময় বাংলাদেশকে নীতি ও কৌশলপত্র তৈরিতে সহায়তা করেছে। কিন্তু গুরুত্বের সঙ্গে এই সংস্থার প্রশংসা করা হয় না।
৭৫ বছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৬৫টি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপন করেছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ১৯৭৮ সালে কাজাখস্তানে আয়োজিত আলমা আতা সম্মেলন। ওই সম্মেলনে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ কথাটি প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল। সংস্থাটির সাপের কামড় ও ক্যানসারবিষয়ক কর্মকাণ্ডে আরও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মীদের জীবন দেওয়ার ঘটনা স্মরণ করেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য আছে। এই বৈষম্য নিরসনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। কোনো দেশ নতুন কোনো ভাইরাস শনাক্তের তথ্য দিলেই অনেক দেশ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। এটা ঠিক নয়। এ জন্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধিমালা সংশোধনের দরকার আছে।
বাংলাদেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৭ সাল থেকে ভূমিকা রেখে চলেছে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দেশে মানসিক স্বাস্থ্যনীতি, আইন, কর্মকৌশল আছে। এসব তৈরিতে সংস্থাটি সহায়তা করেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড ইউএইচসির সহকারী পরিচালক নাহিতুন নাহার বলেন, তাঁদের পাঁচটি গবেষণা কেন্দ্রে সহায়তা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।