দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। এবারের ৩০০ সংসদীয় আসনে লড়ছেন ২৭টি রাজনৈতিক দলের মোট ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী। এর একটি বড় অংশ দলীয় প্রতীকের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ারা। সে ধারাবাহিকতায় এবারে নির্বাচনে ২৬৩টি আসনে দলীয় প্রার্থী দিয়েছে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। এছাড়া দলটির আরও ২৬৯ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন, যারা ইতিমধ্যে ‘আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে ভোটের মাঠে পরিচিতি পেয়েছেন। সে জায়গা থেকে অনেক আসনেই এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের ৪১ নেতার মধ্যে অন্তত ১৪ জন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ছেন। ভোটের মাঠে তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নৌকার মনোনয়নবঞ্চিত ‘জনপ্রিয় স্বতন্ত্র’ প্রার্থীরা।
তথ্য বলছে, এবারের নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার মধ্যে দিয়ে ১৪ দলের শরিকদের ৬টি ও জাতীয় পার্টিকে ২৬ আসনে ছাড় দেওয়া এবং তিনটি আসনে দলের মনোনীত প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়ায় নৌকা নিয়ে এবার নির্বাচন করছেন ২৬৩ জন। এর মধ্যে আছেন কেন্দ্রীয় কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের ৪১ নেতা।
জানা গেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে ও সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিতে দলীয় নেতাদের মধ্যে যারা স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, তাদের বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি আওয়ামী লীগ। এ কারণে দলের মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা এক রকম বিনা বাধায় স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ফলস্বরূপ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও জমজমাট হতে চলেছে।
গত দুই জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও ফরিদপুর-৪ আসনে মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ এবং যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। দুবারই স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সনের কাছে হেরেছেন আওয়ামী লীগের নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী জাফর। তবে এবারও এ দুজনের মধ্যে তীব্র লড়াই হবে বলে মনে করছেন ওই এলাকার ভোটার ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এবার মাদারীপুর-৩ আসনের নৌকা প্রতীকে লড়ছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। ঈগল প্রতীক নিয়ে তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম। এ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে নৌকা ও ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর মধ্যে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ কুষ্টিয়া-৩ আসনে নির্বাচন করছেন। তবে এবার তার সামনে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচবারের মেয়র আনোয়ার আলীর ছেলে পারভেজ আনোয়ার তনু। এ দুই প্রার্থীর মধ্যে এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
এবার চাঁদপুর-৩ আসনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণি। এ আসনে মোট ৭ জন প্রার্থী থাকলেও দীপু মনির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ সামছুল হক ভূঁইয়া। তিনি চাঁদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। এবার সেখানে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে পাশের আসনে দীপু মনির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
ফরিদপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমানকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে পারেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনিও এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। এ নির্বাচনে দলীয় নোঙ্গর প্রতীকে নির্বাচন করছেন প্রবীণ এই নেতা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হওয়া আরিফুর রহমানও এখানে শক্ত প্রার্থী।
চাঁদপুর-২ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য এম ইসফাক আহসানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। মায়া চৌধুরীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমর্থন নিয়ে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন এই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
দলের আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলামকেও ঢাকা-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। এখানেই কামরুল বিরোধীদের ভোট নির্বাচনী হিসাবনিকাশ পাল্টে দিতে পারেন।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন মৌলভীবাজার-২ আসনে। এখানে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ফলে এই আসনে শাহীন সব সময়ই শক্ত প্রার্থী।
আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস নৌকার প্রার্থী হয়েছেন মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে। তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদ ত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব। দুই প্রার্থীর দ্বৈরথ এরই মধ্যে জমে উঠেছে। দুজনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
নেত্রকোনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ইফতিখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু ও মঞ্জুর কাদের কোরাইশী। ফলে এই কেন্দ্রীয় নেতাকে নির্বাচনে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে।
ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সানজিদা খানমকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। লাঙ্গল প্রতীকের বর্তমান এমপি বাবলার সঙ্গে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে সানজিদার।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের ৪৪ সদস্যের মধ্যে রাজিউদ্দিন আহম্মেদ রাজু, নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সালমান ফজলুর রহমান তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে পারেন। নরসিংদী-৫ আসনে সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী। নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত বর্ষীয়ান রাজনীতিক রাজুকে এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে বলে ধারণা করছেন ওই এলাকার মানুষ।
দোহার ও নবাবগঞ্জ নিয়ে গঠিত ঢাকা-১ আসনে ফের ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি আওয়ামী লীগের সালমান ফজলুর রহমান ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম। এই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ। এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। সোনালী আঁশ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন তিনি। রাজনীতির নানা হিসাবনিকাশে এবার নুরুল ইসলাম নাহিদকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হচ্ছে বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী।