গত সেপ্টেম্বর মাসে ভিয়েতনাম সফর করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর ঠিক তিন মাসের মাথায় চলতি সপ্তাহে দেশটি সফর করছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তার এই সফর ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
ভিয়েতনামের ওপর প্রভাব বিস্তারে সম্প্রতি রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেছে পরস্পরবিরোধী দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। যার ফলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেশ দুটির মধ্যে নতুন করে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও শুরু হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের লড়াইয়ে দশকের পর দশক ধরে তাদের পাশে ছিল চীন। অপর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় অতীতের বৈরিতা ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ভিয়েতনামের শাসকগোষ্ঠী।
এ পরিস্থিতিতে চীনের দক্ষিণ সাগর নীতি এবং তা রুখতে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের চীন বিরোধী জোট গঠনের যে প্রচেষ্টা তার কেন্দ্রভূমিতে অবস্থান করছে ভিয়েতনাম।
অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ভিয়েতনামকে কাছে টানতে আগ্রহী দুই পরাশক্তিই। তবে ভিয়েতনামে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হওয়ায় তাদের বশ করতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর পথেই হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্র চীন।
সেই প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সফর ও তার ঠিক তিন মাসের মাথায় মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) দুদিনের সফরে ভিয়েতনাম যান চীনা প্রেসিডেন্ট জিনপিং। তার এই সফরে সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলানোর বিষয়টি।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনাম সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
মূলত অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করার মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করার চেষ্টা করছে বেইজিং। যার মূল উদ্দেশ্য ভিয়েতনামে দিনদিন বাড়তে থাকা মার্কিন প্রভাবকে প্রশমিত করা।
বাণিজ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বিষয়টি। সেখানে বলা হয়েছে দুই পরাশক্তির আধিপত্য বিস্তারের খেলায় ভিয়েতনামকে সতর্কতার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হচ্ছে, যেন দুই পক্ষের সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক অটুট থাকে।
ভিয়েতনাম সফরে গিয়ে হ্যানয়ের সঙ্গে বেইজিংয়ের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি স্মরণ করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নগুয়েন ফু ট্রোং-এর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, চীন ও ভিয়েতনামের সম্পর্ক আরও গভীর হওয়া প্রয়োজন
এর আগে শি জিনপিং গত মাসে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকায় লেখা এক চিঠিতে বলেন, ‘এশিয়া আমাদের সবার বাড়ি। প্রতিবেশীদের দূরে সরানো যায় না। নিজের প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করার মানে হলো নিজেকে সহযোগিতা করা।’
তবে শুধু কূটনৈতিক ভাবেই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী চীন, তা বোঝা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সফরে হওয়া দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরের বহর দেখে। শি জিনপিং এর এই সফরে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষর হয়েছে ৩৭টি সহযোগিতামূলক চুক্তি।
এছাড়া প্রতিবেশী ভিয়েতনামের সঙ্গে যোগাযোগ অবকাঠামো আরও বাড়াতে চায় চীন, এর অংশ হিসেবে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষর হয়েছে আন্তঃসীমান্ত রেল যোগাযোগ বিষয়ক সমঝোতা স্মারক। দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারাই চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় কুনমিং নগরীর সঙ্গে ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলের হাইফং বন্দরের সংযোগ স্থাপনের ব্যাপারে আগ্রহী।
এই রেল সংযোগ হয়ে গেলে চীনে ভিয়েতনামের রপ্তানি আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, পক্ষান্তরে ভিয়েতনামের বন্দর ব্যবহার করে চীন তার উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্টকে আরও গতিশীল করতে পারবে। পাশাপাশি ভিয়েতনামে চীনা বিনিয়োগও আরও বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এই রেল যোগাযোগ।
তবে এই রেল সংযোগের পাশাপাশি চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে ‘বিরল মৃত্তিকা’ বা রেয়ার আর্থ। শিল্প উৎপাদনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই উপাদান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রয়েছে চীনে। তবে চীনের পরই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রেয়ার আর্থ রয়েছে ভিয়েতনামে।
পাশাপাশি দিন দিন ভিয়েতনামে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে চীন। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে দেশটিতে চীনের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৮২০ কোটি ডলারে। এর মাধ্যমে ভিয়েতনামের শীর্ষ বিনিয়োগকারীতে পরিণত হয়েছে তারা।
অবশ্য এই অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রেষারেষিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে ভিয়েতনাম। অর্থনৈতিকভাবে চীনকে ঠেকাতে বেইজিংয়ের ওপর একের পর এক বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ আরোপ করে চলেছে ওয়াশিংটন।
আর এসব বিধিনিষেধে শঙ্কিত হয়ে চীন থেকে নিজেদের সাপ্লাই চেন সরিয়ে নিচ্ছে অনেক পশ্চিমা কোম্পানি, যাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য হচ্ছে ভিয়েতনাম। এমনকি চীনা কোম্পানিগুলোও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানি অব্যাহত রাখতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে ভিয়েতনামে।
ভিয়েতনাম ও চীন উভয় দেশই কমিউনিস্ট মতাদর্শের হলেও তাদের মধ্যে আদর্শিক মতপার্থক্যও কম নয়। কম্বোডিয়ার খেমারুজ গেরিলাদের সমর্থন দেয়াকে কেন্দ্র করে ৮০’র দশকে সরাসরি সামরিক সংঘাতেও জড়িয়েছে দুই দেশ।
এছাড়া বর্তমানে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়েও চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে ভিয়েতনামের। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীনের বিরুদ্ধে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে বিগত বছরগুলোতে ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
আর এই সম্পর্ক জোরদারের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য। দিন দিন হ্যানয়ের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে ওয়াশিংটন। গত সেপ্টেম্বরে দেশটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফরেও প্রাধান্য পায় বাণিজ্য সহযোগিতা।
বর্তমানে ভিয়েতনামের রফতানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রফতানি দাঁড়িয়েছে ১২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। এভাবেই ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার মাধ্যমে দেশটিকে নিজের বলয়ে আনতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
ইতোমধ্যেই হ্যানয়ের সঙ্গে নিজেদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত করেছে ওয়াশিংটন। ওয়াশিংটনের পথ ধরে ভিয়েতনামের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে এই অঞ্চলে প্রধান মার্কিন মিত্র জাপানও।
আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের এই সম্পর্ক জোরদারের বিষয়গুলো মোটেও বেইজিংয়ের দৃষ্টির আড়ালে নেই। ঘরের পাশের প্রতিবেশীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘনিষ্ঠ মাখামাখিকে তারা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
গত অক্টোবরে বেইজিংয়ে হওয়া বৈঠকে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ভো ভ্যান থুঅংকে দুই দেশের মধ্যে অতীতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে স্মরণ করিয়ে দেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
এর পাশাপাশি ভিয়েতনামের যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে প্রবেশ ঠেকাতে হ্যানয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের কৌশল নিয়েও এগুচ্ছে বেইজিং। মূলত ভিয়েতনামে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে এই বিষয়গুলোই।