২০০৪ সালে বাবা প্রণব মুখার্জির কাছে শর্মিষ্ঠা জানতে চেয়েছিলেন, নতুন সরকার গঠন হলে তার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? জবাবে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট প্রয়াত প্রণব মুখার্জি রহস্যময় প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেন, ‘না, তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী বানাবেন না।’
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সোনিয়া গান্ধী সরে যাওয়া পর যখন গুঞ্জন শুরু হয় তাহলে কে হতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী-সেই সময়ে প্রণব মুখার্জিকে এই প্রশ্ন করেন শর্মিষ্ঠা।
শর্মিষ্ঠা মুখার্জি বাবা প্রণব মুখার্জির স্মৃতিচারণ করে একটি বই লিখেছেন। তার ‘ইন প্রণব, মাই ফাদার: এ ডটার্স রিমেমবার্স’ নামে বইটি প্রকাশের অপেক্ষায়। সেখানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) বইটি নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিতে।
শর্মিষ্ঠা মুখার্জি এক সময় কংগ্রেসের মুখাপাত্র ছিলেন। ২০২১ সালে তিনি রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দেন। প্রকাশিতব্য এই বইয়ে তিনি বাবা প্রণব মুখার্জির বর্ণাঢ্য জীবনের অংশবিশেষ তুলে ধরেছেন। শর্মিষ্ঠার কথায়, প্রধানমন্ত্রী না করায় সোনিয়া গান্ধীর প্রতি কোনো ক্ষোভ ছিল না তার বাবার। তখন প্রধানমন্ত্রী হওয়া মনমোহন সিংকে নিয়েও প্রণব মুখার্জির কোনো ঈর্ষা ছিল না।
বইটিতে বাবা প্রণব মুখার্জির লেখা ডায়েরি, বাবা–কন্যার একান্ত আলাপচারিতা এবং গবেষণায় উদ্ঘাটিত প্রণবের রাজনৈতিক জীবনের অজানা দিকগুলো উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন শর্মিষ্ঠা।
প্রণব মুখার্জি একসময় ভারতের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে দেশটির পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছেন। সবশেষ তিনি ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট ৮৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
শর্মিষ্ঠার বইয়ে উঠে এসেছে, ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক গরিষ্ঠতা পাওয়া দল কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে সোনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তে কংগ্রেস ছাড়াও অংশীদার জোটের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। কিন্তু সোনিয়া এই পদে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সোনিয়ার এই সিদ্ধান্ত নিজ দলের নেতাকর্মীসহ ভারতের সব মানুষকে অবাক করে দিয়েছিল।
বইটিতে ‘দ্য পিএম ইন্ডিয়া নেভার হ্যাড’ শিরোনামের অধ্যায়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি লিখেছেন: ‘প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়াতে সোনিয়ার সিদ্ধান্তের পরে গণমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘ড. মনমোহন সিং এবং প্রণবের নাম এই পদের জন্য শীর্ষ প্রতিযোগী হিসেবে আলোচনায় ছিল। বাবা প্রচুর ব্যস্ত থাকায় কয়েক দিন তার সঙ্গে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমি তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। উচ্ছ্বসিতভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করেছি—তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন কি–না। তার জবাব ছিল, না, তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী করবেন না। মনমোহন সিং হবেন।’
সে সময় কে হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী-সোনিয়ার ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা ঔৎসুক্য ফুটে উঠেছিল প্রণবের কণ্ঠে। এ বিষয়ে শর্মিষ্ঠাকে তিনি বলেছিলেন, ‘কিন্তু তার (সোনিয়া) দ্রুত ঘোষণা করা উচিত। এই অনিশ্চয়তা দেশের জন্য ভালো নয়।’
১৯ মে ডায়েরিতে প্রণবকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা যায়। প্রণব লিখেছেন, ‘সমস্যার সমাধান হয়েছে। মনমোহন সিং হতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। মনমোহন ও সোনিয়া জি প্রেসিডেটের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। প্রেসিডেন্ট মনমোহনকে সরকারগঠনের অনুমতি দিয়েছেন।’
শর্মিষ্ঠা মুখার্জি উল্লেখ করেছেন, যদিও সেই সময়ে তার বাবা আর কিছু লেখেননি, ৩১ ডিসেম্বর বছরের বড় ঘটনাগুলো বর্ণনা করার সময় তিনি লিখেছেন, ‘সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ছিল প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে সোনিয়া গান্ধীর আশ্চর্যজনক আত্মত্যাগ। দলের ভেতরে এবং বাইরের চাপ সত্ত্বেও তিনি রাজি হননি। তার এই সিদ্ধান্ত বিজেপি এবং কংগ্রেসের মধ্যে তিক্ত সংঘাত থেকে দেশকে বাঁচিয়েছে।
তিনি আরও লিখেছেন, তার বাবা সোনিয়া গান্ধীকে মনে করতেন ‘বুদ্ধিমতি, পরিশ্রমী এবং শিখতে আগ্রহী একজন ব্যক্তি হিসেবে।
রাহুল গান্ধী সম্পর্কে ডায়েরির প্রথম দিকে একটি উল্লেখ রয়েছে ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সে বছর আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কৌশল নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন প্রণব মুখার্জি।
এর পরে রাহুল গান্ধী তার বাসভবনে এসে সাক্ষাৎ করার বিষয়ও তার ডায়েরিতে উল্লেখ রয়েছে। প্রণব মুখার্জি তাকে ‘খুব বিনয়ী’এবং ‘জিজ্ঞাসু’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাহুলের এ আচরণকে শেখার আকাঙ্ক্ষার চিহ্ন হিসেবে মনে করতেন। তবে তিনি এও অনুভব করেছিলেন যে, রাহুল ‘এখনও রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ব’।
বইয়ে শর্মিষ্ঠা লিখেছেন, রাহুল প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রণবের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, যদিও খুব ঘন ঘন নয়। প্রণব তাকে মন্ত্রিসভায় যুক্ত হতে এবং সরকার পরিচালনায় হাতেকলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের পরামর্শ দিতেন। রাহুল স্পষ্টতই উপদেশে কান দেননি, যেমনটি আমরা সবাই জানি।
২০১৩ সালের ২৫ মার্চ রাহুল তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রণব লিখেছেন, ‘বহু বিষয় নিয়ে রাহুল আগ্রহী। কিন্ত খুবই দ্রুত সে একটা বিষয় ছেড়ে আরেকটা বিষয়ে চলে যায়। আমি জানি না সে আসলে কতটা শোনে ও সে কথা বা পরামর্শ নিজের মধ্যে ধারণের চেষ্টা করে।’