গত কাতার বিশ্বকাপে ৩৬ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে তৃতীয় শিরোপা ঘরে তুলেছিল লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। তিন যুগ আগে পরম আরাধ্যের এ ট্রফিটি আলবিসেলেস্তেদের এনে দিয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। মেসি ও আর্জেন্টিনাকে নিয়ে বিশ্ব ফুটবলে আজ যে উন্মাদনা, উচ্ছ্বাস, মাতামাতি; তার শুরুটা করেছিলেন ম্যারাডোনা। তিনি ফুটবলের ঈশ্বর হিসেবে পরিচিত। আর্জেন্টাইন এ মহাতারকার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ (শনিবার, ২৫ নভেম্বর)।
১৯৬০ সালে ৩০ অক্টোবর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন ম্যারাডোনা। ভক্তদের কাছে ‘এল পিবে দে অরো’ (সোনালী বালক) ডাকনামে পরিচিত ম্যারাডোনা তার খেলোয়াড়ি জীবনের অধিকাংশ সময় আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স এবং নাপোলির হয়ে একজন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন।
ম্যারাডোনার মহাকাব্যিক ইতিহাস রচনার শুরুটা হয়েছিল ১৬ বছর বয়স থেকে। অল্প বয়সেই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান নিজের মেধা ও ফুটবল দক্ষতায়। ছোট দৈহিক গড়নের ছেলেটি ১৯৭৯ সালে জাপানে নিজ দেশের হয়ে অনন্য এক অর্জন বয়ে আনে। ১৯ বছর বয়সেই আর্জেন্টিনার হয়ে যুব বিশ্বকাপ জিতেন তিনি। যেখানে গোল্ডেন বলের (আসরের সেরা খেলোয়াড়) খেতাবও উঠেছিল ম্যারাডোনার হাতে । সেবারই তার দেশ বুঝে গিয়েছিল ফুটবলের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে আসছেন নয়া এক তারকা।
সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ফুটবলারের অধিনায়কত্বে আর্জেন্টিনা ১৯৮৬’র ফুটবল বিশ্বকাপ জেতে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি তার বিখ্যাত ‘হাত দিয়ে গোল’টি করেন, যেটি ‘হ্যান্ড অফ গড’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৯০ সালে আর্জেন্টিনা যখন বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে তখন দলকে নেতৃত্ব দেন ম্যারাডোনা। ইতালিতে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে শেষদিকে পেনাল্টি গোলে পশ্চিম জার্মানির কাছে স্বপ্নভঙ্গ হয় আলবিসেলেস্তেদের। এরপর ১৯৯৪ সালে তিনি আবার আমেরিকায় আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কত্ব করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু অবৈধ মাদক পরীক্ষায় ফেল করার কারণে তাকে আর্জেন্টিনা ফিরে যেতে হয়।
আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা ইতালির ক্লাব নাপোলিতেও রেখেছিলেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৮৪ সালে ২৪ বছর বয়সের দুর্বার ক্যারিয়ারের টগবগে ফুটবল তারকা ম্যারাডোনা যোগ দেন দক্ষিণ ইতালির সাদামাটা দল নাপোলিতে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল, এ ৭ বছর তিনি ক্লাবটির হয়ে দুর্দান্ত সময় পার করেন। ক্লাব ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র ম্যারাডোনা, তার একক নৈপুণ্যে অখ্যাত নাপোলি ঘরে তোলেন ইউরোপ দ্বিতীয় সেরা ট্রফি ইউরোপা লিগ এবং সেই সঙ্গে দুই দুইবার হাত উঁচিয়ে ধরেন ইতালীয় ‘সিরি আ’ ট্রফিও। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে নাপোলি ক্লাবের নাম।
নাপোলি ছিল ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। তিনি নাপোলিকে উজাড় করে দিয়েছেন, সেই সঙ্গে নাপোলিও তাকে চিরদিন মনে রাখার জন্য তার গায়ে জড়ানো ১০ নাম্বার জার্সি কাউকে কখনও দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মৃত্যুর পর নাপোলির ‘সাম পাওলো’ স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘দিয়েগো আরমানদো ম্যারাডোনা স্টেডিয়াম’। ইতালি ও নাপোলির মানুষও তাকে চিরকাল ভালো বেসেছে নিজের ঘরের ছেলের মতো।
ক্যারিয়ারের শেষদিকে ম্যারাডোনা মাদকে আসক্তি নিয়ে সমস্যায় ছিলেন এবং ১৯৯১ সালে তার শরীরের মাদকের উপস্থিতি ধরা পড়লে তাকে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। তার ৩৭তম জন্মদিনে ১৯৯৭ সালে তিনি পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেন। সেসময় তিনি আর্জেন্টিনার বড় দল বোকা জুনিয়ার্সে খেলছিলেন।
ম্যারাডোনাকে গত ৫০ বছরে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন বলে গণ্য করা হয়। বার্সেলোনা এবং নাপোলির মতো ক্লাবেও খেলেছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১টি ম্যাচে তিনি ৩৪টি গোল করেন। আলবিসেলেস্তেদের হয়ে খেলেছেন চারটি বিশ্বকাপ।
খেলোয়াড়ি জীবন শেষে আরও একবার আর্জেন্টিনার হাল ধরেছিলেন ম্যারাডোনাকে। দেশের শিরোপা খরা ঘোচাতে ২০০৮ সালে ম্যারাডোনার কাঁধে জাতীয় দলের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবনে সফল ম্যারাডোনা কোচ হিসেবে সফল হতে পারেননি। ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে হেরে আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেয়। ব্যর্থ বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার কোচের পদ থেকে অবসর নেন ম্যারাডোনা।
বিশ্ব ফুটবলের ঈশ্বর, উজ্জ্বল নক্ষত্র ম্যারাডোনার মৃত্যুর তৃতীয় বছর আজ। ৬০ বছর বয়সে ঘুমন্ত অবস্থায় ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি। তার আলোকিত উজ্জ্বল ক্যারিয়ার বিশ্ব ফুটবল প্রেমীদের হৃদয়জুড়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।