প্রদীপ রায় জিতু, বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি ॥
দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী শেষে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় আর উৎসবমুখর পরিবেশে দিনব্যাপী দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ব্যতিক্রমী মেলা বসেছে।
যা সবার কাছে বাসিয়া হাটি নামে পরিচিত। এ মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরা এখান থেকে পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতে পারেন। এখানে কোনো পাত্র বা পাত্রী পছন্দ হলে পরিবারের মাধ্যমে ধুমধামে বিয়ে দেওয়া হয়।
মেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লোকেরা ছুটে আসেন। এর ফলে পুরো এলাকা লোকারণ্য হয়ে যায়।
মূলত দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, রাজশাহী ও বগুড়া জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের এ মেলায় সবচেয়ে উপস্থিত লক্ষ্য করা যায়। প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে মেলার আয়োজনও করেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলা হিসেবে মেলাটি সাধারণত দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরের দিন বসে।
এই মেলায় আসা অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর বয়স আঠারো পেরিয়ে পঁচিশ মতো। তারা একে অপরের নজর কাড়তে নিজেকে মেলে ধরেন বাহারি পোশাক ও নানা সাজ-সজ্জায়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সব বয়সী নারী-পুরুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। বাহারি সব কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতা, লিপস্টিক, কানের দুল, ঝিনুক ও মাটির তৈরি তৈজসপত্র খেলনা, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দা, কুড়াল, হাড়ি পাতিলসহ বিভিন্ন খাবারের দোকানে পসরা সাজিয়ে রেখেছেন বিক্রেতারা।
মেলায় এতটাই জমসমাগম হয়- যেখানে তিলধারণের জায়গা নেই। মানুষের চাপে ও ভিড়ে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক প্রায় অচল। মেলায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়াও হিন্দু, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও ছিল।
এ ছাড়া মেলায় আগতদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশের সদস্যরা। কোনো প্রকার প্রচার ছাড়াই হাজার হাজার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ উপস্থিত হয়। এই দিনে সেখানে চলতে থাকে বাজনার তালে তালে একক ও দলগতভাবে তাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ। একপাশে গানের আসর আর অন্য পাশে চলে তরুণ-তরুণীদের পছন্দের জীবনসঙ্গী বাছাই।
এ ব্যাপারে রাজশাহী জেলা থেকে আসা তরুণ সোয়ারেন মুর্মু বলেন, ‘একটা সময় এ মেলায় জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব বদলে গেছে। এখন এই রীতিতে ভাটা পড়েছে।’
একই কথা জানিয়ে জয়পুরহাট জেলার বাসিন্দা রানী হাসদা বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। বেশিরভাগ আদিবাসী ছেলে মেয়েরা এখন বিদ্যালয়মুখী হয়েছে। তাই পুরোনো ঐতিহ্যগুলো অনেকটাই মুছে যেতে বসেছে।’
জানতে চাইলে মেলা আয়োজক কমিটি বীরগঞ্জ থানা আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সদস্য শ্যামলাল মুরমু বলেন, ‘পূর্ব পুরুষেরা এ মেলা শুরু করে। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি। তবে কবে থেকে এ মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে সেটি সঠিকভাবে বলা যাবে না। আনুমানিকভাবে কয়েকশ বছর পূর্ব থেকে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলার ব্যাপারে এলাকার সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।’
মরিচা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম চৌধুরী হেলাল বলেন, ‘এ মেলা আমার পূর্ব পুরুষের আমল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তবে আমি নির্বাচিত হওয়ার পর মেলাকে আরও আনন্দমুখর এবং বর্ণিল করার জন্য প্রয়োজনী সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।’