যেকোনো মুহূর্তে ইসরাইলের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া বোমা বা মিসাইল মাথার ওপর এসে পড়তে পারে। যা নিশ্চিত মৃত্যু ঘটাতে পারে। তবে মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়েই গাজা উপত্যকায় খবর সংগ্রহ ও প্রকাশ করে চলেছেন ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা।
ফিলিস্তিনের অধিকৃত গাজা উপত্যকায় অবিরাম ইসরাইলি বিমান হামলা চলছে। ঘরবাড়ি, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কোনো বাছবিচার নেই। হামলায় মিনিটে মিনিটে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে উঁচু উঁচু ভবনগুলো।
ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ছে মানুষ। বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট নেই। খাদ্য ও পানিও শেষ হয়ে আসছে। এরই মধ্যে ইসরাইলের স্থল অভিযানের ডেডলাইন শেষ হয়ে আসছে। যেকোনো সময় শুরু হতে পারে অভিযান।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেও মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় কাজ করে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা। এমন একজন সাংবাদিক রাকান আবদেল রহমান। গাজার একটি ক্যাফে থেকে কাজ করেন তিনি। ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট পরেই তিনি গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের বোমা হামলার খবর সংগ্রহ করেন তিনি।
কিন্তু মিডল ইস্ট আই ও দ্য ন্যাশনাল’র সাংবাদিক আবদেল রহমান কেবল হামলার খবরই সংগ্রহ করছেন না। তিনি ও তার মতো ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের প্রতিনিয়তই নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হচ্ছে।
ইসরাইলের নির্বিচার বিমান হামলায় যেখানে প্রতি মুহূর্তে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, সেখানে যেকোনো সময় একটি বোমা বা মিসাইল সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহের কাজ থামিয়ে দিতে পারে।
‘সাংবাদিকদের টার্গেট করে হামলা চালানো হচ্ছে’
একটানা গত ১০ দিন ধরে ভূমধ্যসাগরপাড়ের চারদিক থেকে অবরুদ্ধ এক চিলতে ভূখণ্ড গাজায় রাতদিন বিরামহীন যুদ্ধবিমান বিমান থেকে বোমা ও মিসাইল ফেলা হচ্ছে। এতে উপত্যকার কয়েকটি এলাকা এরই মধ্যে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
হাজার হাজার বাড়িঘর ও ভবন স্রেফ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। যেসব ছবি ও ভিডিও সামনে আসছে, তাতে মনে হচ্ছে, যেন শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্পের আঘাতে ধসে পড়েছে সব।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামাসের আকস্মিক অভিযানে ইসরাইলে মারা গেছে ১ হাজার ৪০০ জন। কিন্তু গাজায় ইসরাইলের অসম বিমান হামলায় এরই মধ্যে এর দ্বিগুণ তথা ২ হাজার ৮০৮ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। যার এক চতুর্থাংশই নিষ্পাপ নিরীহ শিশু। গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে আরও প্রায় ১১ হাজার।
‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট পরেই কাজ করছেন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক রাকান আবদেল রহমান।
গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বোমার আঘাতে যেসব ভবন ধসে পড়েছে, তার নিচে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আটকা পড়েছে। তাদের কেউ কেউ হয়ত এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু তাদের উদ্ধারে কেউ কিছুই করতে পারছে না। ইসরাইল যেভাবে হামলা চালাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের জীবনের কোনো দাম নেই।
গত সপ্তাহে ইসরাইল অবরুদ্ধ গাজার যোগাযোগ টাওয়ারে বোমা হামলা করে। এবং উপত্যকার একমাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। হামাসের আকস্মিক অভিযানের পর গাজার ওপর ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ ঘোষণা করে ইসরাইল। বিদ্যুৎ, পানি ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। বলা হয়, হামাসের হাতে আটক ইসরাইলি জিম্মি বা বন্দিদের মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ থাকবে।
অব্যাহত বিমান হামলা ও সর্বাত্মক অবরোধের কারণে গাজা উপত্যকায় এখন কার্যত কোনো ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ নেই। এর ফলে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের জন্য খবর সংগ্রহ ও প্রকাশ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এতসব ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিধ্বস্ত গাজার খবর সংগ্রহ ও তা বিশ্ববাসীকে জানানোর চেষ্টা করছেন তারা।
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ আবদেল রহমান বলছিলেন, দুর্বল ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে আমরা সময় মতো রিপোর্ট করতে পারছি না। তার ওপর কাজ করার জন্য উপযুক্ত কোনো জায়গা নেই।’
মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) আল জাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও জানান, ইসরাইলের বিমান হামলার মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই তাদের কাজ করতে হচ্ছে। চিহ্নিত ‘প্রেস’ ভেস্ট ও হেলমেট পরা সাংবাদিকদেরও টার্গেট করে হামলা চালানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
‘প্রতিটি মুহূর্ত বিপজ্জনক’
গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আকস্মিক অভিযানের পর থেকেই গণমাধ্যম অফিস ও সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী।
সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) তথ্য মতে, ইসরাইলের হামলায় রয়টার্সের এক সাংবাদিকসহ এখন পর্যন্ত অন্তত ১৬ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন।
আবদেল রহমান বলেন, ‘যেসব স্থানে ম্যাসাকার তথা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটছে সেই জায়গাগুলোর খবরও সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে পারি না। এমনকি বোমা বিস্ফোরিত স্থানগুলোতেও যেতে পারি না এই ভয়ে যে একই এলাকায় আবারও হামলা চালাতে পারে ইসরেইল।’
তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতি সেকেন্ডে আপনি বিপদের মুখে পড়বেন। সাইদ আল-তাওয়েল, মোহাম্মদ সুব ও হিশাম আলনওয়াজার মতো আমাদের সহকর্মীরা এরই মধ্যে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।’