শিখ নেতা হারদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের জেরে গরম ভারত-কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্ক। ভারতের বিরুদ্ধে হরদীপ সিংকে হত্যার অভিযোগ এনে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে কানাডা। এতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজুড়ে শিখদের নিহত ও আটকের অন্যান্য ঘটনাও আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ যুক্তরাজ্যের ঘটনাগুলো বেশ জোরালোভাবে সামনে আসছে।
চলতি বছরের জুন মাসে বার্মিংহামে আকস্মিক অসুস্থতায় মারা যান ৩৫ বছর বয়সী অবতার সিং খান্দা নামের একজন শিখ নেতা। তিনি স্বাধীন খালিস্তানের পক্ষে বেশ সরব ছিলেন। আকস্মিক অসুস্থতায় মৃত্যুর খবর জানা গেলেও স্বজনদের দাবি, এর পেছনেও কোনও চক্রান্ত রয়েছে।
যদিও ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস পুলিশ বলেছে, তারা কেসটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেছে এবং সন্দেহজনক কিছু পাননি। যার কারণে পুনরায় তদন্ত করার প্রয়োজন নেই।
ডাম্বারটনের শ্রম কাউন্সিলর এবং আইনজীবী গুরপ্রীত জোহল। তিনি বলেন, তার পরিবারের সঙ্গে যা ঘটেছিল তার জন্যই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। কিন্তু কী ঘটেছিল তার পরিবারের সঙ্গে?
ছয় বছর আগে গুরপ্রীতের ভাই শিখ অধিকার কর্মী জাগতার জোহল বিয়ে করতে ভারত গিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের দাবি, তাকে (জাগতার) পাঞ্জাবের রামি মান্ডি শহরে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং চরমপন্থী কর্মকাণ্ডের অভোগ তোলা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
জাগতার জোহল বলেছেন, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সই করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বিচার হয়নি।
মানবাধিকার গোষ্ঠী রিপ্রিভ বলেছে, তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে যে জাগতার জোহালকে ব্রিটিশ নিরাপত্তা সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভারতে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
গুরপ্রীত জোহাল বলেছেন, ‘জাস্টিন ট্রুডো ন্যায্য কাজ করছেন। তিনি তার দেশের নাগরিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যেখানে যুক্তরাজ্য সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মনে হয় ব্রিটেন সরকার নিজ দেশের নাগরিকদের চেয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে বেশি মনোযোগী।’
যদিও ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, জাগতার জোহলের মুক্তির আহ্বানে লাভ হবে না, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। যদিও প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, তিনি জোহালের মামলাটি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছর হয়ে গেলেও এ নিয়ে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি ব্রিটেন।
ভারত এবং যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ শক্তিশালী। কিন্তু প্রায়ই ভারতীয় কর্মকর্তারা ব্রিটেনে শিখদের সক্রিয়তা ও তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন।
চলতি বছরের মার্চ মাসে, লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে ভাঙচুর করেন শিখ অধিকার এবং খালিস্তানপন্থী বিক্ষোভকারীরা। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত। ‘চরমপন্থা’ মোকাবিলার জন্য বারবার ব্রিটেনের প্রতি আহ্বান জানায় ভারত সরকার।
১৯৮০’র দশকে ভারতে শিখ সম্প্রদায়ের নিজস্ব স্বাধীন দেশের পক্ষে সমর্থন কমে যায়। সে সময় দেশটির প্রায় সব রাজনৈতিক দল এর তীব্র বিরোধিতা করে। কিন্তু সম্প্রতি আবার এই আন্দোলনের পুনরুত্থান ঘটেছে। বিশেষ করে শিখ প্রবাসীদের মধ্যে অধিকার নিয়ে বেশ সোচ্চার হতে দেখা গেছে।
১৯৮৪ সালে শিখ রাজ্যের জন্য ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা এবং আন্দোলনের মুখে লেফটেন্যান্ট জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রারের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনারা অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে হামলা চালায়। এই হামলায় শত শত শিখ নিহত হন। এর চার মাস পর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেন তার শিখ বডিগার্ডরা। যার ফলে ভারতজুড়ে ব্যাপক শিখবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়; যাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যান।
এরপর ২০১৪ সালে লন্ডনে যাওয়ার সময় অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রারের ওপর হামলা করা হয়। সে সময় ছুরির আঘাতে তার মুখ ও গলা চিরে ফেলা হয়। যদিও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। এ ঘটনায় একজন ব্রিটিশ শিখকে গ্রেফতার করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ওই শিখের বাবা ও ভাই অমৃতসারের মন্দিরের হামলায় মারা যান। দীর্ঘ ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জেনারেল ব্রারের ওপর হামলা করেন।
কিন্তু স্কটিশ শিখ জাগতার জোহালের কারাবাসের পাশাপাশি অনেক ব্রিটিশ শিখ কয়েক বছরের ঘটনাগুলো সামনে এনে দাবি করছেন যে, ভারতের কারণে তাদের শিখ সম্প্রদায় চাপের মধ্যে রয়েছে। ২০১৮ সালে লন্ডন এবং মিডল্যান্ডসে পাঁচজন শিখ অ্যাক্টিভিস্টের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। শিখদের দাবি, এই অভিযানের বিবরণ ভারতীয় মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছিল যার কথা ব্রিটিশ পুলিশ প্রকাশ করেনি। এ থেকে বোঝা যায় যে এই অভিযানে দিল্লির হাত ছিল।
যুক্তরাজ্য সরকারের ফেইথ এনগেজমেন্ট অ্যাডভাইজার কলিন ব্লুমের ব্রিটেন ফেইথ ল্যান্ডস্কেপের সাম্প্রতিক পর্যালোচনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে থাকা ব্রিটিশ শিখরা।
কারণ কলিন ব্লুম তার কয়েক বছরের গবেষণার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মুসলিম, অতি ডান এবং হিন্দু চরমপন্থার চেয়ে শিখদের নাশকতামূলক কার্যকলাপের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন।
গত মাসে যুক্তরাজ্যের হোম অফিস ‘খালিস্তানিপন্থী চরমপন্থা’ ইস্যু মোকাবিলায় ৯৫ হাজার পাউন্ড বরাদ্দ দিয়েছে। ভারতে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে খালিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদের আবেদন কমলেও এই সমস্যাটি ব্রিটিশ শিখদের মধ্যে উত্তেজনা এবং বিভাজন সৃষ্টি করে চলেছে।
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিখ স্টাডিজের অধ্যাপক জগবীর ঘুট্টি জোহাল ওবিই বলেছেন, ‘শিখ সম্প্রদায় ব্রিটিশ সমাজে মিশে গিয়েছিলো। তারা তাদের শিক্ষাগত অর্জন এবং নিঃস্বার্থ সেবার জন্য পরিচিত।’
তিনি বলেন, ‘চরমপন্থা’র প্রতি ভারত ও যুক্তরাজ্য সরকারের অতিরিক্ত নজরদারিকে পক্ষপাতদুষ্ট মনে করছেন শিখরা। যা এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। এর ফলে অনেক শিখ উভয় সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
অধ্যাপক জোহল সতর্ক করে বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিখ চরমপন্থা মোকাবিলায় যেসকল পদক্ষেপ এবং কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে কোন কাজে আসবে না, বরং উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্যের কৌশল এবং কানাডা থেকে আসা নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডের খবর তরুণ শিখদের উদ্বেগ বাড়াবে। তারা আগে এসব বিষয়ে আগ্রহী না হলেও এখন খালিস্তানের ধারণা, শিখদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধের বিষয়ে সক্রিয় হবে।’