জার্মানির ক্লাব ফুটবল মানেই মূলত পশ্চিম জার্মানির ফুটবল। এক সময়ের সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির ক্লাবগুলো নামের ভারে বা অর্থের ঝনঝনানিতে তাদের ধারেকাছেও নেই। তবে সেখানকারই এক অখ্যাত ক্লাব রূপকথার গল্প লিখে চলেছে। জার্মানি মাতিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ইউরোপের এলিট মঞ্চে। ইতিহাস গড়ে এবার চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত তারা ক্লাব ফুটবলের সফলতম ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের। ক্লাবটির নাম ইউনিয়ন বার্লিন।
‘ইউনিয়ন বার্লিন’ নামটা রূপকথার গল্পের চেয়ে মোটেও কম রোমাঞ্চকর নয়। পুর্ব বার্লিনের শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করা ক্লাবটির নেই অর্থের ঝনঝনানি। নেই কোনো বড় তারকাও। ক্লাবের স্টেডিয়ামে নেই জাঁকজমক। তারপরও সাদামাটা ইউনিয়ন বার্লিন একের পর এক বিস্ময় জন্ম দিয়েই চলেছে। ক্লাবটির সাফল্য রীতিমতো কপালে চোখ তুলে দিয়েছে ফুটবল্প্রেমীদের। অর্থের ঝনঝনানির যুগেও শুধু ফুটবলের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ও খেলোয়াড়-সমর্থকদের আপ্রাণ চেষ্টায় অসাধারণ এক ক্লাবে পরিণত হয়েছে পূর্ব বার্লিনের এই ক্লাব।
বুন্দেসলিগায় ২০২২-২৩ মৌসুমেও শিরোপা জিতেছে বায়ার্ন মিউনিখ। এই নিয়ে টানা ১১ মৌসুম শিরোপা জিতে নিয়েছে ব্যাভেরিয়ানরা। বায়ার্ন ছাড়াও বুন্দেসলিগায় প্রভাবশালী অন্যান্য দলগুলোও পশ্চিম জার্মানিরই। এরই মধ্যে চলতি মৌসুমে সকলের চোখ কপালে তুলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা করে নিয়েছে ইউনিয়ন বার্লিন। লিগের শেষ ম্যাচে ওয়ের্ডার ব্রেমেনকে ১-০ গোলে হারিয়ে বুন্দেসলিগায় চতুর্থ হয়েছে দলটি। তাতেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সুযোগ পেলো পূর্ব বার্লিনের ক্লাবটি। অথচ মাত্র চার বছর আগে ২০১৯ সালেই ক্লাবটি খেলত জার্মান ফুটবলের দ্বিতীয় স্তরে।
২০১৯ সালের ২৭ মে, প্লে-অফে স্টুটগার্টকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলিগায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ইউনিয়ন বার্লিন। ২০১৯-২০ মৌসুমে প্রথমবার বুন্দেসলিগা খেলার পর ২০২১ সালে বুন্দেসলিগার পয়েন্ট টেবিলে ৭ নম্বরে থেকে প্রথমবারের মতো উয়েফার কোনো টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাই করে তারা। সুযোগ পায় তৃতীয় সারির দলগুলোর আসর উয়েফা কনফারেন্স লিগে।
এর পরের সিজনেও জারি থাকে বার্লিনের রূপকথা। ২০২১-২২ মৌসুমে বুন্দেসলিগায় পঞ্চম হয়ে জায়গা করে নেয় ইউরোপা লিগে।
তবে আরও বড় চমক তখনও বাকি। চলতি মৌসুমে লা লিগায় চতুর্থ হয়ে ইউনিয়ন বার্লিন জায়গা করে নিয়েছে ইউরোপের এলিট দলগুলোর আসর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে।
এমন সাফল্যের দেখা পাওয়া দলটার নেই বড় তারকা কিংবা অ্যাকাউন্টে নেই অর্থের ঝনঝনানি। বুন্দেসলিগায় তাদের বেতন-বিল দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। জার্সি স্পন্সর থেকে আয়ও লীগের সর্বনিম্ন, যা চ্যাম্পিয়ন বায়ার্নের চেয়ে ২৩ গুণ কম। টিভিস্বত্ব থেকেও তাদের আয় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
ইউনিয়ন বার্লিনের এমন সাফল্যের সবচেয়ে বড় দাবিদার ক্লাবটির ফ্যানবেজ। ক্লাবটার দুঃসময়ে সবসময় পাশে ছিল তারা। এমনকি ক্লাবটার অস্তিত্ব রক্ষা করতে রক্ত পর্যন্ত দিয়েছে সমর্থকরা!
না, কোনো যুদ্ধ বা সংগ্রামে রক্ত দেয়নি তারা। বরং ক্লাবের অস্তিত্ব বাঁচাতে নিজেদের রক্ত বিক্রি করে টাকা দিয়েছিল সমর্থকরা।
২০০৩/০৪ সেশনে দলটি থার্ড ডিভিশনে নেমে যায়।জার্মান ফুটবল ফেডারেশন লীগে খেলার জন্য ১.৫ মিলিয়ন ইউরো গ্যারান্টি মানি হিসেবে চায়। ক্লাব সেই পুরো অর্থ দিতে না পারলে নিজের ক্লাবকে বাঁচাতে মাঠে নামেন সমর্থকরা।
‘ব্লিড ফর ইউনিয়ন’ নামে রক্তদানের এক ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে তারা। জার্মানিতে রক্ত দান করলে তার বিনিময়ে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। সেই দানের উপার্জিত অর্থ ফেডারেশনে পাঠানো হয় গ্যারান্টি মানি হিসেবে।
শুধু এবারই নয়, ২০০৮ সালে স্টেডিয়াম রিনভেশন এর জন্য যখন অর্থের ও সময়ের প্রয়োজন, সেই সময়ও মাঠে নামেন এই ইউনিয়ন বার্লিন সমর্থকরা। প্ররায় ২৫০০ সমর্থক ১ লক্ষ ৪০ হাজার কর্মঘণ্টা সময় দেন স্টেডিয়াম পুনঃনির্মান করতে। এর পরের বছরেই তৃতীয় বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উঠে আসে ইউনিয়ন বার্লিন। এরপর ২০১৯ সালে বুন্দেসলিগায় প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে তো একে একে রূপকথার গল্প লিখেই চলেছে তারা।
ইউনিয়ন বার্লিনের সমর্থকদের অপেক্ষা এখন আগামী মৌসুমের। নতুন মৌসুমে যে নিজেদের হাতে গড়া স্তাদিওন আন ডার অল্টেন ফর্স্টেরেই স্টেডিয়ামে বসে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দলের খেলা দেখবেন তারা। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়!