বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপির মিডিয়া সেল ও মার্কিন সহায়তায় চলা ‘সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ’ (সিজিএস) উভয়ই বিএনপিপন্থি একটি গ্রুপের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। গ্রুপটি বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানোয় যুক্ত রয়েছে এবং দেশে-বিদেশে সরকারবিরোধী নানা প্রচারণা চালাচ্ছে।
আর এই গ্রুপের একজন সদস্যকে সম্প্রতি ‘বাংলাদেশে গুজব মোকাবিলা’র নামে অর্থায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন তৎপরতা নিয়ে নতুন করে বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সম্প্রতি ‘অ্যালামনাই এনগেজমেন্ট ইনোভেশন ফান্ড ২০২২’র (এইআইএফ) অধীনে ‘কনফ্রন্টিং মিসইনফরমেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ভুয়া তথ্য ও গুজব মোকাবিলা বিষয়ক একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
‘অ্যালামনাই এনগেজমেন্ট ইনোভেশন ফান্ড ২০২২’ বা এইআইএফ’র ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো ‘নির্বাচনের সময় কার্যকরভাবে ভুল তথ্য ও গুজব মোকাবিলা করার জন্য ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং বা তথ্য যাচাই সক্ষমতা বাড়ানো এবং সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনফ্লুয়েন্সারদের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা।’
এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে ‘ভোটার হয়রানির ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ব্যালট স্টাফিং বা অনিয়ম রোধে’ নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহি করতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও ভোটারদের সংগঠিত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই প্রকল্প ‘গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সহনশীলতা ও সুশাসনের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে সমর্থন এবং অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে’ বলেও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
এই প্রকল্পের জন্য যাকে নির্বাচন করা হয়েছে তিনি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সাইমুম পারভেজ। যিনি বিএনপির মিডিয়া সেল প্রকাশিত ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’র নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকলেও শিক্ষাছুটি নিয়ে বেলজিয়ামে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করছেন।
বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে প্রকাশিত ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সাইমুম পারভেজকে এই অনুদান দেয়া হয়েছে। তার বাবা শাহজাহান মিয়া বিএনপির চাঁপাই নবাবগঞ্জ শাখার সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সাইমুম পারভেজের সাথে আরও যারা জড়িত তারা হলেন বিতর্কিত টকশো ‘তৃতীয় মাত্রা’র উপস্থাপক সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান ও মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইমুম পারভেজের সাবেক সহকর্মী ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করছেন)।
আরও আছেন সাজ্জাদুর রহমানের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়েমা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক ড. কাজলি শেহরিন ইসলাম ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক কর্মকর্তা নাজমুল আরিফীন যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়ন করছেন।
এ ধরনের সংগঠনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত সময় সংবাদকে বলেন, শুধু এই সংস্থাই না, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে বিভিন্ন এনজিও বা এ ধরনের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের কাজ করছে। বিভিন্ন দেশে যারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে, নিজেদের পক্ষে জনমত রক্ষায় তাদেরকে কাজে লাগায়। এটা অনেকটাই দলীয় সংগঠন ধরনের। তাই সেখানে অর্থ দিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্ট চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিএনপির পক্ষে অপপ্রচার
সিজিএস মার্কিন অর্থায়নে চলা একটি বিতর্কিত সংস্থা। এটি নিজেকে একটি গবেষণা সংস্থা হিসেবে ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন এগিয়ে নিতে কাজ করছে’ দাবি করলেও বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্ক উসকে দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এর প্রধান নির্বাহী বিতর্কিত টকশো ‘তৃতীয় মাত্রা’র উপস্থাপক জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি, সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারের অভিযোগ রয়েছে। তার প্রতিষ্ঠান সিজিএসের অর্থায়নের উৎস নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠলেও বারবার তা এড়িয়ে গেছেন জিল্লুর রহমান।
সিজিএস মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্বিতীয় সিআইএ’ খ্যাত ‘ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’র (এনইডি) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হয়। এটি এনইডি’র সামনের সংগঠন ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ (সিআইপিই) থেকেও তহবিল গ্রহণ করে। যারা ‘বেসরকারি উদ্যোগ ও বাজার-ভিত্তিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করছে’ বলে দাবি করে থাকে।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল আবদুর রশীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন উপস্থাপক জিল্লুর রহমান। সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল পাকিস্তানের মাটিতে আর প্রচার করা হয়েছিল চ্যানেল আইতে। সাক্ষাৎকারে রশীদের মন্তব্য রাষ্ট্রবিরোধী হলেও জিল্লুর বলেন, এ নিয়ে তার কোনো অনুশোচনা নেই।
অন্যদিকে সাইমুম পারভেজ সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মনে করা হয়, তিনি ‘কনফ্রন্টিং মিসইনফরমেশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তহবিল ‘রোড টু ডেমোক্রেটি’ নামে বিএনপি মিডিয়া সেলের বয়ান প্রচার ও এটাকে বই আকারে প্রকাশ করতে ব্যয় করেছেন। আর এ কাজে তাকে সহায়তা করেছেন জিল্লুর রহমান ও তার সিজিএস, সাজ্জাদুর, সায়েমা, কাজলি ও নাজমুল।
সাইমুম পারভেজ ‘গণমজাতন্ত্র’ নামে একটি ব্যাঙ্গাত্মক ফেসবুক পেজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কথিত আছে, এই পেজটির পরিচালন ব্যয়ও তিনি অ্যালামনাই এনগেজমেন্ট ইনোভেশন ফান্ড ২০২২ (এইআইএফ) থেকেই নিয়ে থাকেন। পেজটির ৯৮ শতাংশ পোস্টই সরকার ও আওয়ামী লীগবিরোধী।
অজয় দাশগুপ্ত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বলতে চায় তারা কোনো দলের পক্ষে না, তারা মানবাধিকারের পক্ষে! কিন্তু এই যে তারা যাদের মাধ্যমে এখানে কাজ করে, তাতে কিন্তু দেখা যায় যে কোনো দলের পক্ষে এমনকি সাম্প্রদায়িক শক্তির পক্ষে তারা কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, যারা সন্ত্রাসবাদ প্রশ্রয় দেয়, তাদের ব্যাপারে তারা জিরো টলারেন্স। কিন্তু দেখা যায়, তারা যাদের মাধ্যমে এই কাজগুলো করছে, তাদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদের পক্ষের শক্তিও আছে। আর যুক্তরাষ্ট্র তারা নিজের স্বার্থেই তাদেরকে ব্যবহার করছে।
সিনিয়র সাংবাদিক কুদ্দুস আফ্রাদ সময় সংবাদকে বলেন, যে প্রতিষ্ঠানকে অর্থ সহায়তা দেয়া হয় তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা সেটি খতিয়ে না দেখে অর্থ বরাদ্দ দিলে সেটির মিসইউজ হতে পারে। বরাদ্দটাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এক্ষেত্রে ওই প্রকল্প সফলতার পরিবর্তে বিফল হবে। গুজবের মাত্রা আরও বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন গুজব রটানোর জন্য
অজয় দাশগুপ্ত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থায়নটা করছে, সেটা গুজব মোকাবিলার জন্য না, গুজব রটানোর জন্য। এটাকে তারা গুজব মোকাবিলা বা অবাধ পরিবেশের নামে চালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে, তারা সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়ায়। তারা যে কথা বলে অর্থায়ন করছে বাস্তবের সঙ্গে সেটা বিপরীত। আর সেই বিপরীত কাজটা যারা করছে, তাদেরকেই অর্থ দেয়া হচ্ছে।
‘যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বাংলাদেশের উন্নয়নে কল্যাণ ও মানবাধিকারের কথা বলে, তাই তাদের উচিত এ ধরনের কাজে যুক্তদেরকে সহায়তা না করা’, বলেন তিনি।
কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যদি প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ থাকে তাহলে সেটা বাতিল করাটাই বাঞ্ছনীয় হবে। কারণ এমন অর্থ বরাদ্দ গুজবকে আরও উৎসাহ দেবে। যদি রাজনৈতিক চিন্তার পক্ষে থাকে তাহলে তারা সেসব গুজব নিবৃত করবে না। অন্যদিকে বিপক্ষে গেলে গুজব না হলেও সেটাকে গুজব বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে।
নির্দিষ্ট একটি দলের রাজনৈতিক কর্মীদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে ভোটার হয়রানি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ব্যালট স্টাফিং তথা অনিয়ম রোধে নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহি নিশ্চিত করবে সেটাই এখন প্রশ্ন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে নির্বাচনকালে ভুয়া তথ্য ও গুজব মোকাবিলায় সঠিক প্রকল্পে ও সঠিক ব্যক্তির মাধ্যমে মার্কিন জনগণ তথা করদাতাদের অর্থ ব্যয় করা উচিৎ যুক্তরাষ্ট্রের। শুধু তখনই এটা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার সহায়ক হবে।