Homeআন্তর্জাতিকবিশ্বের সশস্ত্রবাহিনীগুলোর গ্যাস নিঃসরণ নিয়ে কেউ কি কিছু ভাবে!

বিশ্বের সশস্ত্রবাহিনীগুলোর গ্যাস নিঃসরণ নিয়ে কেউ কি কিছু ভাবে!

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচুর কথাবার্তা হয়। কিন্তু গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের অনেক বড় একটি কারণ সবসময়ই এড়িয়ে যাওয়া হয়। তা হলো বিশ্বের সশস্ত্রবাহিনীগুলোর গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের বিষয়টি।

বৈশ্বিক তাপমাত্রার পারদ এরইমধ্যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই অবস্থায় বৈশ্বিক পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো জাতিসংঘসহ বিশ্বের সরকারগুলোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে যেন বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলো কী পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করছে তা প্রকাশ করা হয়।

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের তথ্য বলছে, বিশ্বের অন্যতম বড় জ্বালানি তেল ব্যবহারকারী খাত হলো সামরিক বাহিনী। ২০২২ সালের একটি অনুমান বলছে, বিশ্বের মোট গ্রিনহাউজের সাড়ে ৫ শতাংশই নিঃসরণ করে সামরিক বাহিনীগুলো।

তবে বিপুল পরিমাণ কার্বন বা গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করলেও সামরিক বাহিনীগুলো তাদের নিঃসরণের পরিমাণ প্রকাশে বাধ্য নয়। এ বিষয়ে কোনো আন্তর্জাতিক আইন বা বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বিশ্বের অধিকারগোষ্ঠী এবং পরিবেশবাদী সংগঠন ও বিজ্ঞানীরা দাবি জানিয়েছেন, জাতিসংঘের উচিত বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলোকে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের হিসাব প্রকাশের বিষয়টিকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

পরিবেশবাদী সংগঠন পারস্পেকটিভ ক্লাইমেট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অ্যালেক্স মিশেলোয়া বলেছেন, ‘সংঘাত সংশ্লিষ্ট খাত থেকে যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হয় জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জে তা হিসাব করা হয় না। ফলে প্রকৃত হিসাবে বড় একটি ব্যবধান থেকে যায়।’

তবে অনেক দেরিতে হলেও বিশ্বের সামরিক বাহিনীগুলোর নিঃসৃত গ্রিনহাউজ গ্যাস পরিমাপ করার বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয়েছে বিশ্ব। জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশ কিছু অগ্রগতি হলেও এখনো বর্তমান ফ্রেমওয়ার্ক সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। তবে আসন্ন কপ-২৮ সম্মেলনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিষয়টি আলোচিত হবে।

এরই মধ্যে কিছু সামরিক বাহিনী বা জোট তাদের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের বিষয়টি প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। ৩১ দেশের সামরিক জোট ন্যাটো জানিয়েছে, তাদের সদস্য দেশগুলো কীভাবে সামরিক বাহিনীর কার্বন নিঃসরণ কমানো যায় সে বিষয়ে একটি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।

এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং নিউজিল্যান্ড চেষ্টা করছে তাদের সশস্ত্রবাহিনী কী পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করছে তা জানার বিষয়ে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে। যুক্তরাষ্ট্র তো কপ-২৭ সম্মেলনে সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিনিধিও পাঠিয়েছিল। এসব উদ্যোগের ফসলও ফলতে শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স লজিস্টিক এজেন্সি জানিয়েছে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্রবাহিনী ৮ কোটি ৪০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল কিনেছিল। যা ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ব্যারেল কম। পাশাপাশি ২০২২ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হয়েছিল ৪ কোটি ৮০ লাখ টন, বিপরীতে তার আগের বছর ২০২১ সালে এই পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ১০ লাখ টন। তবে এই হিসাবেও অনেক খাতই বাদ পড়ে গিয়েছিল। যেমন, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, বাংকারে ব্যবহৃত জ্বালানি থেকে নিঃসরণ ইত্যাদি।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক নেটা ক্রাফোর্ড বলেছেন, ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সেনা অপসারণ, বিভিন্ন খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, আরও জ্বালানিবান্ধব যানবাহন তৈরি, সামরিক অভিযান ও অনুশীলনের পরিমাণ কমার কারণে বিশ্বজুড়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ কমেছে। রণক্ষেত্রে ড্রোনের মতো প্রযুক্তির বহুল ব্যবহারও কার্বন নিঃসরণ কামানোর ক্ষেত্রে অনেকটাই ভূমিকা রেখেছে।

এক জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘সবচেয়ে বড় নির্গমন হ্রাসকারী প্রযুক্তির মধ্যে একটি হলো মনুষ্যবিহীন আকাশযান ড্রোনের ব্যবহার।’ তার মতে, যেহেতু ড্রোনে মানুষকে পাঠাতে হয় না তাই জ্বালানিও তুলনামূলক কম লাগে। একারণে নিঃসরণও কম।

যুদ্ধ তথা সামরিক খাত যে বিপুল কার্বন নিঃসরণ করে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠে নেদারল্যান্ডসের কার্বন নিঃসরণ পরিমাপ করা বিজ্ঞানী লেনার্ড দে ক্লার্কের অনুমান থেকে। তার মতে ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর তথা ১২ মাসে অন্তত ১২ কোটি টন গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসৃত হয়েছে। যা কিনা সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড ও সিরিয়া এক বছরে সামষ্টিকভাবে যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে তার সমান।

যাইহোক, অনেক দেশই হয়তো এখনো তাদের সামরিক বাহিনীর গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ পরিমাপ করার বিষয়ে সচেতন নয়। বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনে কোনো অনুশীলন এখনো চালু হয়নি। অথচ বিশ্বের এই অংশটিকে কেনোভাবেই বাতিল করা সম্ভব নয়।

ফলে যতক্ষণ না বিশ্বের সব দেশের সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো একটি প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত পদ্ধতি অনুসরণ না করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণকে আসলে কোনোভাবেই পরিপূর্ণরূপে পরিমাপ করা যাবে না বলেই মত গ্লোবাল রেসপনসিবিলিটির বিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট পারকিনসনের।

সর্বশেষ খবর