তার সুর আর বাণী দোলায় বাঙালির অন্তর। সীমাহীন প্রেম, প্রকৃতি, প্রার্থনা, জীবন এবং জগতের সকল অনুভূতি মিশেছে যেন তার গানে। তার সংগীত শ্রোতাকে ভাসায়; দেয় অজানা অনুভূতির সন্ধান। এ সংগীতেই সবচেয়ে আপন করে পাওয়া যায় তাকে। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রোববার (০৬ আগস্ট) আজ ২২শে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২তম প্রয়াণ দিবস। বাঙালির জীবনের অনেকটা জুড়ে সতত বিরাজমান এ মনীষীতুল্য ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয় এমনই শ্রাবণের এক দুপুরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম বাঙালির জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে নানাভাবে।
দেশ-বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা তাঁর ভাবনা ও জীবনদর্শনের অনন্য দলিল। তাঁর দুটি গান দুটি দেশের—বাংলাদেশ ও ভারতে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের এবং ‘জন গণ মন’ ভারতের জাতীয় সংগীত। রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র সৃষ্টির অন্যতম প্রধান ধারা তাঁর অসাধারণ গানগুলো।
গান দিয়ে হাত বুলিয়ে যাই এ ভুবনে’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনব্যাপী অভিযানে গানই ছিল তার চির সারথি। দ্বিসহস্রস্পর্শী তার বিচিত্র গানের যে আয়োজন, তাতে প্রত্যয় ছিল, নিরীক্ষা ছিল আর ছিল সৃজনের আনন্দ। অস্পর্শ কিন্তু অনুভববেদ্য গানে আমরা পেয়ে গিয়েছি সংগীত সমুদ্রে সঞ্চরণমাণ সানন্দ এক মুগ্ধ মনকে।
‘সবচেয়ে স্থায়ী আমার গান’ এই ছিল রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস। এ বাণী সাধক কত যে সারস্বত অভিব্যক্তি ও কলারীতির মন্থন-আবর্তে নিজেকে ঘূর্ণিত করে গিয়েছেন তবুও দেখি, তার আত্মপক্ষ কবুলতি, আমার গান তোমাদের গাইতেই হবে।
গানে গানে বন্ধন মুক্তির সাধনা করেছেন। মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন শুভবোধ। তাইতো তিনিই বিনম্র অহংকারে বলেছিলেন, এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায় আমি যে গান গেয়েছিলাম।
রবীন্দ্রনাথের গানে কৌশলে বোনা আছে শুধু দেখা পাওয়া শুধু ছুঁয়ে যাওয়ার বিভঙ্গ, কিংবা দেখা-না দেখার চমৎকৃতি; নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর প্রত্যক্ষণের আনন্দ।
রবীন্দ্রনাথের গানের সমুদ্রেই বাঙালির বাস। হুট করে নামা বৃষ্টিতে, জোছনা ও জলে, আনন্দ-বিষাদে রবির সুর যেন আপনা আপনি বেজে ওঠে। ২২ শে শ্রাবণ কেবল উপলক্ষ, রবির কিরণ পাওয়া জীবনের প্রতি অনুক্ষণে।
বাংলা ভাষাকে বিশ্ব অঙ্গনে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের নোবেলপ্রাপ্তির ঘটনা। সাহিত্যের সীমা ছাড়িয়ে শিক্ষা, দর্শন, পল্লী ও কৃষি উন্নয়নের পাশাপাশি বহু বিষয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত ভিন্ন ধরনের শিক্ষায়তন বীরভূমের শান্তিনিকেতনে একসময় সমাবেশ ঘটেছিল নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকৃতির মধ্যে রয়েছে অসংখ্য কবিতা ও গানের পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনি ও চিঠিপত্র।
সংগীতপ্রতিভা পারিবারিক সূত্রেই বিকশিত হয়েছিল তাঁর মধ্যে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে গানের বাণী ও সুরে নব নব নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তবে রবীন্দ্রসংগীত একান্তভাবেই তাঁর নিজস্বতায় ভরপুর। মানবজীবনের যাবতীয় ভাব ও রসের ছায়া পড়েছে তাঁর সংগীতে। বিশ্বকবির প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার এবং বেসরকারি টেলিভিশনগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও নাটক প্রচার করছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম- ১৮৬১ সালের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে। কয়েক পুরুষ আগে তাঁর পূর্বপুরুষরা পূর্ববঙ্গ (আজকের বাংলাদেশ) থেকে ব্যবসার সূত্রে কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন।
বাংলা ১৩৪৮ সনের শ্রাবণ মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। চিকিৎসকরা পরামর্শ করে ঠিক করেন, অস্ত্রোপচার করতেই হবে। ৯ শ্রাবণ (২৫ জুলাই) শান্তিনিকেতন থেকে ৮০ বছর বয়সী ভগ্নস্বাস্থ্যের কবিকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। ৩০ জুলাই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার হয়। জীবনী থেকে জানা যায়, মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে পর্যন্তও কবি সৃষ্টিশীল ছিলেন। জোড়াসাঁকোতে রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি বলতেন শান্তিনিকেতনের তরুণ আশ্রমিক (পরে লেখিকা, শিল্পী) রানী চন্দ লিখে নিতেন। অস্ত্রোপচার করা হলেও তা কাজে আসেনি। অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। এর পর চলে না ফেরার দেশে।