জিল্লুর রহমান (ছদ্মনাম) সিঙ্গেল ফাদার। একা হাতেই সন্তানকে মানুষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কিন্তু অফিসে থাকাকালীন তার ৬ বছরের শিশুটিকে গৃহপরিচারিকার কাছেই রেখে যেতে হয়। তবে ইদানীং তিনি লক্ষ করছেন, তার হাসি- খুশি শিশুটি অল্পতেই রেগে যাচ্ছে। অফিস থেকে ফিরতে রাত হওয়ায় তিনি সন্তানকে সময়ও দিতে পারছেন না। ফলে শিশুর সমস্যাটিও তিনি ধরতে পারছেন না।
অপরদিকে ৪ বছরের আদুরে সন্তান মিমি। আজকাল বাবা-মাকে আবদারে আবদারে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তার সবকিছু চাই! আর না পেলেই জেদ-কান্না-চিৎকার-চেচামেচি। ফলে বাধ্য হয়ে তার অনেক অন্যায় আবদারও বাবা-মা পূরণ করে থাকেন।
উপরের দুটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে শিশুদের অবাধ্য আচরণে বাবা-মায়েরা নিরুপায় বোধ করছেন। আসলে শিশুদের রাগ, জেদ, ক্ষোভকে বাবা-মায়েরা আমলে নিতে চান না। তারা ভেবে বসেন যে এরূপ আচরণ শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তি।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে শিশুদেরও রয়েছে স্বতন্ত্র সত্ত্বা। তারা পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শেখে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে। কোনো কারণে তাদের অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে পরিস্থিতির অমিল হলে তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ভীতি, ক্লান্তি, একঘেয়েমি ও অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণেও শিশুদের আচরণে পরিবর্তন ঘটে। তারা অল্পতেই রেগে যায়। এ ছাড়াও বংশগত কারণে তাদের মাঝে এরূপ আচরণ প্রকাশ পেতে পারে।
কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, শিশুদের বদমেজাজি হওয়ার পেছনে তাদের অভিভাবকদেরও রয়েছে ভূমিকা। অভিভাবকদের আচরণ এবং কাজ শিশুদের আচরণে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যা সংশোধন করলে, আপনি আপনার শিশুর আচরণেও পরিবর্তন আনতে পারবেন।
শিশুসন্তান একরোখা হওয়ার কারণ:
বাবা- মায়ের মাঝের বিষাক্ত সম্পর্ক সন্তানের বেড়ে ওঠাতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তারা যখন সন্তানের উপস্থিতিতেই ঝগড়া করেন তখন তা শিশুর ভেতরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করে। এখান থেকে মূলত রাগ বা জেদের সূত্রপাত ঘটে।
শিশুদের সামনে বড়রা যখন কটূক্তি করেন তখন তারাও সে ভাষা রপ্ত করার চেষ্টা করে। ফলে নিজের অজান্তেই তারা রাগী আচরণ করে ফেলে।
অনেক সময় ছোট শিশুদের জেদকে টেম্পার ট্যানট্রাম বলা হয়। সে এই জেদকে হাতিয়ার বানিয়ে নিজ স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। এ রকম চলতে থাকলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার আচরণে নেগেটিভিটি বাড়তে থাকবে। তাই সন্তানের সব অমূলক আবদার পূরণের আগে বাবা-মায়ের ভেবে নেয়া উচিত এর পরিণতি কী হতে পারে।
শিশুরা অনুকরণ করেই শেখে। তারা যখন দেখে তার পরিবারের সদস্য অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ করে তখন তারাও এ আচরণটি আয়ত্ত করে ফেলে। ফলে বড়দের সাথেও তারা দুর্বব্যহার করা স্বাভাবিক বলে মনে করে।
শিশুকে শারীরিক প্রহার করা তাদের মাঝে রাগ ও ক্ষোভ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। শিশুরা যখন জেদ করবে তখন তাদের ওপর রাগ না ঝেড়ে, শান্তভাবে তাদের নিয়ে বসতে হবে। তাদের রাগ হওয়ার কারণ জানতে চাইতে হবে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে শিশুরা তাদের মনোভাব প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ না করে। কারণটি জেনে সে অনুযায়ী তাকে কাউন্সেলিং করতে হবে।
শিশুর কথা এবং কাজকে গুরুত্ব না দিলে তার মাঝে হীনমন্যতা সৃষ্টি হয়, যা থেকে রাগের সূত্রপাত। বাসার পরিবেশ শিশুর কাছে অনিরাপদ মন হলে তার আচরণে তা প্রতিফলিত হয়। সে অকারণেই সব বিষয়ে রাগ প্রকাশ করতে থাকে। তাই শিশুকে বিশ্বাস করাতে হবে নিজ বাসাই তার নিরাপদ আশ্রয়স্থল, এখানে তার মতামতের গুরুত্ব রয়েছে।
একক অভিভাবক অথবা যেসব বাবা-মায়েরা কাজের চাপে থাকেন এবং সন্তানদের সময় দিতে পারেন না, তাদের আচরণ বাচ্চাদের মাঝে অনিশ্চতয়তা, নিরাপত্তাহীনতা বা রাগ তৈরি করে থাকে।
শিশুর মানসিক ও আচরণগত সমস্যা তাদের একরোখা জেদি হওয়ার পেছনে একটা কারণ। অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার আছে এমন শিশুরা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। ফলে তাদের আচরণেও তা প্রভাব ফেলে। শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা ও উৎকণ্ঠা রোগ থাকলেও তাদের আচরণ খারাপ হয়ে থাকে।
আপনাকে বুঝতে হবে শিশুদেরও নিজস্বতাবোধ আছে। তাই তার প্রতিটা সিদ্ধান্তে বাধা দিলে সে একরোখা বনে যাবে।
আমাদের বুঝতে হবে রাগ, জেদ কিংবা ক্ষোভ কিছু আচরণ মাত্র। তাদের মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। তাই শিশুদের যেমন আমাদের বুঝতে হবে, তেমনি নিজেদের উদ্বেগের বিষয়টিও শিশুদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। এতে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়বে এবং শিশুর অবাধ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।