Homeঅর্থনীতিমাইক্রোচিপ নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব প্রযুক্তি খাতকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

মাইক্রোচিপ নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব প্রযুক্তি খাতকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের মাইক্রোচিপ নিয়ে দ্বন্দ্ব আরও উত্তপ্ত হওয়ার মধ্যেই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের দুটি প্রধান উপাদান রফতানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন। সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে উভয় দেশের লড়াইয়ের মধ্যে চীনের এমন পদক্ষেপ বিশ্বে কী প্রভাব ফেলবে, সেই বিষয়টি নিয়েই বিবিসির এই প্রতিবেদন।

জুলাইয়ের শুরুর দিকে চিপ তৈরিতে গুরুত্বপুর্ণ দুটি উপাদান রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে বেইজিং। চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কাস্টমস বিভাগের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, চিপ তৈরিতে প্রয়োজনীয় ধাতু গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম রফতানি করতে হলে এখন থেকে আলাদা লাইসেন্সের প্রয়োজন হবে। ১ আগস্ট থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর হয়। চীন এ দুটি খনিজ ধাতুর প্রধান উৎপাদক। ইলেকট্রনিকস ও কম্পিউটার চিপসহ সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে এই দুটি উপাদান ব্যবহার করা হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াশিংটন চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মার্কিন চিপ ও প্রযুক্তি কিনতে বাধা দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই রকম রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে চীন। এর মাধ্যমে চীন সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাইছে।

যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক সপ্তাহে সেমিকন্ডাক্টর রফতানিতে বিধিনিষেধ আরও কঠোর করেছে। পাশাপাশি মিত্রদেরও একই কাজ করতে চাপ দিচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বরে নেদারল্যান্ডসও চিপ তৈরির উদ্দেশ্যে প্রযুক্তি রফতানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করবে। সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারী বিশ্বের অন্যতম প্রধান কোম্পানি এএসএমএল নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত।

সারা বিশ্বে যে পরিমাণ গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম ব্যবহার করা হয় তার সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারীই হচ্ছে চীন। শিল্প সংস্থা ক্রিটিক্যাল র ম্যাটেরিয়ালস অ্যালায়েন্সের (সিআরএমএ) অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত গ্যালিয়ামের ৮০ শতাংশ এবং জার্মেনিয়ামের ৬০ শতাংশই সরবরাহ করে চীন।

এই দুই উপাদানকে মূলত ‘মাইনর মেটাল’ হিসেবে অবহিত করা হয়। যার অর্থ হলো, এগুলো প্রকৃতিতে এমনিই পাওয়া যায় না, সাধারণত অন্যান্য প্রক্রিয়ার উপজাত বা বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে এইটি তৈরি হয়ে থাকে।

বিশ্বের এই বৃহত্তম দুই অর্থনীতির দেশ দুটোর মধ্যে এমন ক্রমাগত পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের কারণে ‘সম্পদের জাতীয়তাবাদ’ প্রবৃত্তির প্রবণতার উত্থানের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রবণতায় একটি দেশের সরকার অন্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো নিজেদের কাছে মজুত রেখে দেয়।

বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির ক্রিটিক্যাল ম্যাটেরিয়াল রিসার্চ ফেলো ড. গ্যাভিন হার্পার বলেছেন, ‘আমরা দেখছি, বিভিন্ন দেশের সরকার বিশ্বায়নের ধারণা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারগুলোয় সহজভাবে পণ্য পাওয়া যাবে, এই ধারণা এখন আর নেই। বড় পরিসরে দেখলে বোঝা যায় যে পশ্চিমা শিল্পের অস্তিত্ব কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে।’

গ্যালিয়াম আর্সেনইউ হচ্ছে একটি যৌগিক পদার্থ, যেটি গ্যালিয়াম ও আর্সেনিকের যৌগ। এটি মূলত হাই-ফ্রিকোয়েন্সি কম্পিউটার চিপ, লাইট এমিটিং ডায়োডস (এলইডি লাইট) এবং সোলার প্যানেল উৎপাদনে তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। সিআরএমএ তথ্য বলছে, বিশ্বের খুব কমসংখ্যক কোম্পানিই ইলেকট্রনিকস পণ্যে ব্যবহারযোগ্য নিখাদ গ্যালিয়াম আর্সেনাইড উৎপাদন করে থাকে।

অন্যদিকে মাইক্রোপ্রসেসর এবং সোলার সেল তৈরিতেও জার্মেনিয়াম ব্যবহার করা হয় উল্লেখ করে কলিন হ্যামিলটন বলেন, সামরিক বাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিশন গগলসেও এটি ব্যবহার করা হয়। এর বিকল্প হিসেবে আঞ্চলিকভাবেই যথেষ্ট সরবরাহ থাকা উচিত। তবে এটি নিশ্চিত করা কঠিন। কেননা, এই খাতজুড়ে চীন আধিপত্য বিস্তার করে আছে।

এ ক্ষেত্রে রিসাইক্লিংয়ের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে জানান তিনি।

এদিকে গত মাসে পেন্টাগনের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জার্মেনিয়ামের মজুত থাকলেও, গ্যালিয়ামের তেমন মজুত নেই।

প্রতিরক্ষা বিভাগ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, মাইক্রো ইলেকট্রনিকসের জন্য গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামসহ যেসব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রয়োজন হয়, সেগুলো সরবরাহ নিশ্চিতে দেশের অভ্যন্তরে খনিজ পদার্থ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজতের জন্য তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে।

তবুও চীনের রফতানি বিধিনিষেধ দীর্ঘ মেয়াদে সীমিত প্রভাব ফেলবে বলে জানান তিনি।

রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে এমন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপ জানিয়েছে, যদিও গ্যালিয়াম এবং জার্মেনিয়ামের শীর্ষ রফতানিকারক চীন, তার সত্ত্বেও কম্পিউটার চিপের মতো উপাদানগুলো উৎপাদনের জন্য যেসব উপকরণ প্রয়োজন সেগুলো উৎপাদনের বিকল্প উৎস রয়েছে। কারণ, চীনের বাইরেও সক্রিয় খনি ও প্রক্রিয়াকরণের সুবিধা রয়েছে।

এক দশক আগে যখন চীন বিরল কিছু খনিজ পদার্থ রফতানির বিধিনিষেধ দেয়, তখনও এই সংস্থাটি একই ধরনের কথা বলেছিল। ইউরেশিয়া বলছে, এরই মধ্যে আরও রফতানিকারক দেশের আবির্ভাব ঘটেছে। ফলে এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থ সরবরাহ ব্যবস্থায় চীনের আধিপত্য ৯৮থেকে কমে ৬৩ শতাংশে নেমেছে।

গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামের জন্য বিকল্প উৎসের আরও বিকাশ ঘটবে আশা প্রকাশ করে ইউরেশিয়ার পরিচালক আনা অ্যাশটন বিবিসি বলেন, একই সঙ্গে এই পণ্য রিসাইক্লিং প্রক্রিয়াও জোরদার করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিকল্প উৎসের সন্ধানেও তৎপরতা আরও বাড়বে। তবে এটি কেবল চীনের সম্প্রতি ঘোষিত রফতানি নিষেধাজ্ঞার কারণে হবে, এমন নয়। এটি ঘটবে মূলত ক্রমবর্ধমান চাহিদা, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত প্রতিযোগিতা ও অবিশ্বাসের জন্য।

এদিকে গত বছর অক্টোবরে ওয়াশিংটন এক ঘোষণায় জানায়, যেসব কোম্পানি মার্কিন উপকরণ বা সফটওয়্যার ব্যবহার করে চীনে চিপ রফতানি করে, তাদের লাইসেন্স নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেগুলো বিশ্বের যেখানেই তৈরি করা হোক না কেন, লাইসেন্স নিতে হবে।

ওয়াশিংটনের এমন সিদ্ধান্তের জবাবে চীন প্রায় সময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রযুক্তি খাতে একক আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করার অভিযোগ তুলেছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় মহাকাশ সংস্থা লকহিড মার্টিনের মতো আমেরিকার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত কোম্পানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে চীন। এরই মধ্যে, পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এসব খনিজ পদার্থ ও তৈরি পণ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনতে এবং সক্ষমতা বাড়াতে, বিশেষ করে গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামের মতো উপাদানকে প্রস্তুত করতে তাদের আরও কয়েক বছর সময়ে লাগবে। তবে এসব পদার্থের সংকটকে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো খনি-সমৃদ্ধ দেশগুলো দীর্ঘ মেয়াদে একটি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারে বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এসব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে অস্ত্র হিসেবে করলে, যেমনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়ই করছে, তা বিশ্বের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে না, এমন নতুন সব গ্রিন প্রযুক্তি এসব উপকরণের ওপর নির্ভরশীল।

ড. হারপার জানান, এটি একটি জাতীয় সমস্যা নয়। এটি এমন একটি সমস্যা যা মানবজাতি হিসেবে আমরা মোকাবিলা করছি। আশা করছি, নীতিনির্ধারকরা গুরুত্বপূর্ণ এসব উপাদান নিরাপদ ও সহজলভ্য করতে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।

যদিও রফতানি নিয়ন্ত্রণের সবশেষ এই বিধিনিষেধ এখনই শিল্প বা ভোক্তা পর্যায়ের বিপর্যয় ডেকে আনবে না, তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন যে এই প্রবণতা কোন দিকে যাচ্ছে, সে দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

Exit mobile version