একদিকে করোনা, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ – এ দুটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বৈশ্বিক সংকট। ধারণা করা হচ্ছিল, বড় রকমের আর্থিক মন্দার মুখে পড়বে বিশ্ব; দেখা দিতে পারে দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে কোটি কোটি মানুষ। তবে বর্ত মানে সব শঙ্কা ছাপিয়ে ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রমান্বয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ভালোর দিকে যাচ্ছে। যুদ্ধ চলমান থাকলেও এর প্রভাব কমে আসছে। এছাড়া এরই মধ্যে মহামারি কাটিয়ে ওঠেছে বিশ্ব। এসবের বাইরে সরবরাহ ব্যবস্থায় যে সমস্যা ছিল, তাও ধীরে ধীরে করোনা পূর্ববর্তী সময়ের স্বাভাবিক রূপে ফিরে এসেছে।
চলতি বছরের শুরুর প্রথম চার মাসেই বোঝা যাচ্ছিলো যতটা শঙ্কা করা হয়েছে ২০২৩ সাল নিয়ে, তার সিকিভাগও সত্যি হচ্ছে না। দুর্ভিক্ষের ভয় থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। খাদ্যপণ্যের দামের পাশাপাশি কমেছে জ্বালানির দাম। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমতে যতটা সময় লাগবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, তার থেকেও কম সময়ে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ সবের বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে এক রকমের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে সেটি কমে এসেছে। এ ব্যাপারে মার্কিন কর্তৃপক্ষ জোরালো ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করে আইএমএফ।
তবে আইএমএফ বলছে, ভয় কেটে গেলেও উদযাপন করার মতো কিছু এখনো ঘটেনি। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুকের তথ্য থেকে জানা যায়, গত বছর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৭ শতাংশ, যা চলতি বছর কমে ৬.৮ শতাংশে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ২০২৪ সালে এ মূল্যস্ফীতি আরও কমে হবে ৫.২ শতাংশ।
ইউরোপের মূল্যস্ফীতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভোক্তা পণ্যের মূল্যস্ফীতি (সিপিআই) এখন থেকেই কমতে শুরু করেছে। গত জুনে এ মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ, যা জুলাইতে আরও কমতে পারে। যদিও আইএমএফ বলছে, মূল্যস্ফীতি কমলেও প্রবৃদ্ধির হার আশানুরূপ বাড়বে না। গত বছর প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৩ শতাংশ হলেও, চলতি বছর এবং আগামী বছর তা কমে ৩ শতাংশ হবে। তবে ইউরোপের চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোর মূল্যমান বাড়াটা বলছে সব ঠিক থাকলে চলতি বছর প্রবৃদ্ধিও বাড়তে পারে।
বেরেনবার্গের প্রধান অর্থনীতিবিদ হোলগার শিমেডিং বলেন,
ইউরোপ থেকে পুতিনের কুছায়া সরে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সহনশীল হচ্ছে, বাড়ছে চাকরির হার এবং বেতনের প্রবৃদ্ধি। আগামী কয়েক মাসে অবস্থা আরও উন্নতির দিকে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
আইএমএফ বলছে, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি হ্রাস প্রমাণ করে বিশ্ব অর্থনীতি ঠিক পথে হাঁটছে। তবে এতকিছুর মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যাংকগুলো যে কঠিন নীতি অনুসরণ করছে সেটি চলতে থাকলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত এবং সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিপদের মুখে পড়বে। এছাড়া সামষ্টিক মূল্যস্ফীতি কমলেও এর বাইরের কেন্দ্রীয় মূল্যস্ফীতি (জ্বালানি ও খাবারের দাম) কমছে অপেক্ষাকৃত ধীরে। এতে করে দিনশেষে শঙ্কা না থাকলেও কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যায়।
এদিকে, বৈশ্বিক চাকরির বাজার নিয়ে আইএমএফ বলছে, দিনকে দিন বেকারত্বের হার কমে এসেছে। করোনার সময়ে যে বেকারত্বের হার বিশ্বকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল সেটি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। শুধু চাকরি না, বেড়েছে বেতনও, তবে বাজারে পণ্যের দামের সঙ্গে এখনো বেতনের সামঞ্জস্য হতে সময় লাগবে। তবে অর্থনীতির দিক দিয়ে বিবেচনা করলে, শ্রমমূল্য কম থাকায় পণ্য উৎপাদনে খরচ কম হবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এভাবে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলে বেতন ও পণ্যের দামের ব্যবধান অনেকটাই কমে আসবে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি।
চলতি বছর মার্চে ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে এত সমস্যা থাকার পরেও শেয়ারবাজারে এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম পড়েছে। বিশেষ করে টেক কোম্পানিগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার কোম্পানিগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে এবং এতে করে বেড়েছে এ সংশ্লিষ্ট শেয়ারের দাম। উন্নয়নশীল এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ডলার নিয়ে যে হাহাকার দেখা দিয়েছিল তাও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সাল থেকে মূল্যস্ফীতির একটি বড় ঝাপটা আঘাত হেনেছিল বিশ্ব অর্থনীতিতে। সেসময় মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কঠোর মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছে, যা এখনো বিদ্যমান। জুলাইয়ের ২৭ তারিখ ফেডারেল রিজার্ভ সবশেষ তাদের সুদহার বাড়িয়েছে যা ভেঙেছে গত ২২ বছরের রেকর্ড। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ বারের মতো সুদহার বাড়াল মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। শূন্য দশমিক ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ। আগে যা ছিল ৫.২৫ শতাংশ।
ফেডারেল রিজার্ভ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলমান কার্যক্রমের অংশ হিসাবে ১৭ মাসে ১১ বারের মতো নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। ভবিষ্যতে সুদের হার আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মূলত মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে মুদ্রানীতি নিয়ে নানা ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে ফেড।
তবে আইএমএফ বলছে, মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে ভেবে মুদ্রানীতি সরল করে দিলে হবে না। হঠাৎ করে মুদ্রানীতি নিয়ে অবহেলা শুরু করলে, সুদ হার কমিয়ে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। এ অবস্থায় অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে সুদহার ঠিক করা ও মুদ্রানীতি প্রণয়ন করার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি।
এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে নিজেদের অর্থনীতি এবং মুদ্রানীতি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করে সেদিকেও জোর দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে, ভর্তুকির ব্যাপারে এসব দেশকে সাবধান করে দিয়েছে আইএমএফ। বিশ্বে জ্বালানির দাম কমতে শুরু করায়, মূল দামের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য রেখে ধীরে ধীরে ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসতে হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া জলবায়ু এবং বিশ্ব মেরুকরণের মতো বিষয়ে সামষ্টিক সমাধানের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল।