Homeরাজনীতিবাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স একটা পর্যালোচনা

বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স একটা পর্যালোচনা

আ ফ ম মাহবুবুল হক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পর্যালোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ-কে বাদ দিলে বা তার রাজনৈতিক, আদর্শিক, সামরিক ভূমিকাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে পুরো পর্যালোচনাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ‘৭১-এর নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে যারা বিএলএফ সংগঠনের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেছেন তারা দীর্ঘদিন থেকে ধারবাহিকভাবে গড়ে ওঠা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃস্থানীয় সংগঠন ও নিরলস আদর্শবাদী কর্মী হিসেবেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। বিএলএফ-এর প্রধান চার জন নেতা তথা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ ষাটের দশক থেকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ছিলেন। যে রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনে তারা নেতৃত্ব প্রদান করেছেন সেই সংগঠন তথা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কিছুটা উপলব্ধি না করলে বিএলএফ-কে সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব হবে না।

ষাটের দশক থেকে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে দুটো ধারা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। একটি ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। আরেকটি ধারা হলো, পাকিস্তানি প্রায়-উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ধারা; ‘৬৪ সাল থেকেই যাদের কার্যক্রমের শুরু। পরে এ দুটো ধারা রব-সিরাজ গ্রুপ ও মাখন-সিদ্দিকী গ্রুপ নামে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিহিত ও পরিচিত ছিল। রব-সিরাজ গ্রুপের শ্লোগান ছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, ৬ ও ১১ দফা, না এক দফা’- এক দফা, এক দফা”, “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ইত্যাদি। আর সিদ্দিকী-মাখন গ্রুপের ছিল ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, পাতি বিপ্লবী খতম করো’ ইত্যাদি বক্তব্যের মাধ্যমে পাকিস্তানে বাঙালিরাজ প্রতিষ্ঠার শ্লোগান। আপসহীন স্বাধীনতার পক্ষের ধারায় যারা যুক্ত ছিলেন তারা ৭০-এর নির্বাচনের সময় বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা নিয়ে ও স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিরাগভাজনও হন।

ঐ সময়ে কয়েক মাসের জন্য আমাকেও সিরাজগঞ্জের প্রতিটি থানায় দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রার্থীদের সঙ্গে বিতর্কও করতে হয়েছিল। ‘৭১-এর ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক কর্তৃক জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল স্থগিত ঘোষণা, ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম রব কর্তৃক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ কতৃক স্বাধীন বাংলা ছাত্র সমাজের পক্ষে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ৭ মার্চে রেসকোর্সে শেখ মুজিবের ঘোষণা এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের নির্মম সামরিক হত্যাযজ্ঞের পর ২৭ মার্চ মেজর জিয়া কর্তৃক শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা’- সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আহ্বান ইত্যাদি বাংলাদেশের জনগণকে দলমত নির্বিশেষে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মাওলানা ভাসানী ও সিরাজ সিকদারের অবদানও বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রণিধানযোগ্য।

‘৭১-এর ২৫ মার্চের পর ঢাকাসহ সারা দেশে পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বাঙালিদের জাতীয় জাগরণ ও স্বাধীনতার চেতনাকে যখন ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন বীর বাঙালি ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, সিপাহী জনতা যার যা শক্তি আছে তাই নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ‘৭০ সালের আগস্টে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তাবে আমরা যারা পক্ষে ছিলাম, তারা এই প্রতিরোধ যুদ্ধে দেশের ভিতরে ও বাইরে থেকে সর্বাত্মকভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লাম। ঢাকা, মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে দেওয়া নির্ধারিত দায়িত্ব পালন শেষে আমরা যারা ঢাকার জিঞ্জিরায় ফিরে এলাম, আমাদের বলা হলো নিজেদের দায়িত্বে কলকাতায় গিয়ে সামরিক ও অন্যান্য কাজে প্রশিক্ষণ নেয়ার লক্ষ্যে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। ঢাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের দিকে যাওয়ার পথে ফরিদপুরে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনিও একই কথা বললেন। দর্শনা দিয়ে ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে ট্রেনে যখন উঠলাম, কলকাতাগামী ট্রেনের কামরায় এক ভদ্রলোক আমাদের বললেন, কংগ্রেস ও ইন্দিরাজী পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী ও প্রগতিশীলদের যেভাবে নির্মম উপায়ে দমন করছে, তারা আপনাদের ‘জয়বাংলা’র সংগ্রামকে নিঃস্বার্থভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করবে, তা আশা করেন কীভাবে? সময়ই আপনাদের বলে দেবে ভারতের শাসক শ্রেণি আপনাদের সংগ্রামে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্য কী। ভারতের মাটিতে প্রথমেই এ অভিজ্ঞতা আমাদেরকে আরেকটু সজাগ ও সচেতন করার ক্ষেত্রে বাস্তব ভূমিকা পালন করল। কলকাতায় গিয়ে নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে আসা আওয়ামী নেতাদের মন্তব্য, বক্তব্য ও আর্তচিৎকার শুনে হতচকিত হয়ে গেলাম। তাদের অনেকের বক্তব্য ছিল- ‘ছাত্রদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো ও পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর কারণেই আজকে আমাদের কলকাতায় আসতে হলো।’

বাংলাদেশকে স্বাধীন করার সংগ্রাম গড়ে তোলার নিউক্লিয়াস’ নামে যে অংশটি পরিচিত ছিল, যার প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক, এর সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমদকে যুক্ত করা হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তোলা ও শেখ মুজিবর রহমানের কাছে একে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে। উপরোক্ত নেতাদের নেতৃত্বে বিএলএফ গড়ে ওঠে প্রচলিত স্বাধীনতা যুদ্ধের বাহিনী অর্থাৎ এফএফ-এর পাশাপাশি একটি দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে ব্যাপক জনগণকে রাজনৈতিক, আদর্শিক ও সাংগঠনিকভাবে যুক্ত করে পরিপূর্ণ মুক্তিসংগ্রামে পরিণত করার লক্ষ্যে। দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট ও তার আওতায় রাজনৈতিক দলসমূহ, সিপাহী, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতাকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে শরিক করার কাজটি না হওয়ায় আধাশেঁচড়া অবস্থায় এফএফ-এর মাধ্যমে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন-তাদের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ ও নেতৃতু দ্বারা পরিচালিত করা ও ব্যাপক জনগণকে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে রাজনৈতিক, নৈতিক, আদর্শিক ও সাংগঠনিকভাবে যুক্ত করে, প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করে জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার লক্ষ্যেই প্রধানত পরিপূরক ও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যভিত্তিক সংগঠন হিসেবে বিএলএফ-কে গড়ে তোলা হয়।

‘৭০-এর নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে আওয়ামী লীগের বহৎ ভারী শিল্প জাতীয়করণসহ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি থাকলেও আওয়ামী লীগ শ্রেণিগত দার্শনিক- রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে সমাজতন্ত্রী, এমনকি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সংগঠনও ছিল না। বাঙালি উঠতি বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন হিসেবেই আওয়ামী লীগের উৎপত্তি ও বিকাশ। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন রব-সিরাজ গ্রুপ ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত। নিলেও সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার ধারায় শ্রমিক-কৃষকরাজ প্রতিষ্ঠার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিটি তাঁদের কাছে স্বচ্ছ ছিল না। এরা বাস্তব সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় প্রথমে র্যাডিক্যাল পেটিবুর্জোয়া চিন্তাধারা ও। পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক সমাজবাদী তথা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ধারায় পরিবর্তিত ও তৎপরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী চিন্তাভাবনা দ্বারা সাধারণভাবে প্রভাবিত হলেও দার্শনিক, রাজনৈতিক, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিকভাবে সব ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের চিন্তাধারা দ্বারা পরিচালিত হতে পারেনি।

উপরোক্ত দুটো ধারার সংমিশ্রণে বিএলএফ গঠিত হওয়ার পর রাজনৈতিক দার্শনিক ভিত্তি একক ও স্পষ্টভাবে কখনো বিবৃত ও বিধৃত হয়নি। বিএলএফ-এর প্রথম ব্যাচ হিসেবে আমাদের সামনে বক্তব্য তুলে ধরা হলো- ‘৬২-এর চীন-ভারত যুদ্ধের পর্যদস্ত অবস্থা থেকে উন্নীত হয়ে ভারত এই অঞ্চলের সামরিক শক্তি হিসেবে আস্থাযোগ্য অবস্থায় এসে পুনরায় দাঁড়িয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী পরাশক্তিদের মোকাবেলা করে এ যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা ও তাকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া তার জন্য অসুবিধাজনক নয়। আমরা যারা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করছি, তাদের যেমন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে, তেমনি কমিউনিস্টদেরও মোকাবিলা করতে হবে। আমরা কমিউনিস্ট মতাদর্শে তখনও পুরোপুরি পরিচালিত না হলেও কমিউনিস্ট বিরোধী তো নইই। এমতাবস্থায় মতাদর্শগতভাবে বিএলএফ-এর ভারতীয় প্রশিক্ষকদের ঘোষিত অবস্থান জেনে তার বিরোধিতা করতে না পারলেও আমরা নিজেরা দৃঢ়ভাবে এ মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলাম যে, সামরিক ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের মতাদর্শানুযায়ী আমাদের দেশে আমরাই তো কাজ করবো, সুতরাং ভবিষ্যতে আমাদের স্বার্থে এ সংগঠনকে আমরাই পরিচালনা করবো।

প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং সমাপ্তির পর বিএলএফ-এর ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণের প্রশাসনিক দায়িত্ব হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়াসহ আমাদের হাতে এলো। আমরা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম বিধায় চতুর্দশ-পঞ্চদশ ব্যাচ পর্যন্ত যারা ভারতীয় প্রশিক্ষক ও আমাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল তারা মূলত আমাদের মতাদর্শ দ্বারাই প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়েছিল। আমাদের তখন পাঠ্য ছিল চে’গুয়েভারা, নগুয়েন গিয়াপ, মাও সে তুঙ-এর গেরিলা যুদ্ধের ওপর লিখিত বক্তব্যসমূহ। এসব গেরিলা মিলিটারি স্ট্রাটেজিস্টদের বক্তব্যও আমাদের মতাদর্শের কাজকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছে।

বিএলএফ-এর যে প্রধান চারটি সেক্টর ছিল তা নিম্নরূপ-
১. কেন্দ্রীয় সেক্টর। এলাকা: বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ঢাকা জেলার অংশ বিশেষ। সেক্টর প্রধান: আবদুর রাজ্জাক, উপ-প্রধান : সৈয়দ মাহমুদ।
২. পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর। এলাকা: পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, নোয়াখালী ও ঢাকার কিছু অংশ। সেক্টর প্রধানঃ শেখ ফজলুল হক মণি। উপ-প্রধান আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদুস মাখন।
৩. দক্ষিণাঞ্চলীয় সেক্টর। এলাকা: বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী। সেক্টর প্রধান: তোফায়েল আহমেদ, উপ-প্রধান ও কাজী আরেফ আহমেদ।
৪. উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর। এলাকা: বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহী। সেক্টর প্রধান: সিরাজুল আলম খান। উপ-প্রধান : মনিরুল ইসলাম।

বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্বের বিন্যাস ও পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী চিন্তাধারার প্রভাবের বৃদ্ধিও প্রমাণ করে বিএলএফ নেতৃত্বের বাস্তব অবস্থানের কারণেই সংগঠনটির প্রধান অংশ বলতে গেলে প্রায় পুরোটাই প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা দ্বারা পরিচালিত হয়। বিভিন্ন ব্যাচ প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর যখন দেশে ফিরে যেত তখন তাদের সামনে যে বক্তব্য, লক্ষ্য ও শ্লোগান তুলে ধরা হতো তাও ছিল দেশের অভ্যন্তরে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-জনতাকে একাত্ম করে দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধ তথা জনযুদ্ধ সম্পর্কিত। তখন শ্লোগান ছিল ‘মুজিববাদ’; যার ব্যাখ্যা ছিল এ রকম- ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে শ্রমিকরাজ-কৃষকরাজ প্রতিষ্ঠাই হবে মুজিববাদ।’ এই বক্তব্যে কিছু অসম্পূর্ণতা থাকলেও তখনকার বাস্তবতায় এই বক্তব্য যুক্তিযুক্ত ছিল।

আমরা যারা বিএলএফ ক্যাম্পের প্রশাসনিক-রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলাম।।তারা শারীরিক-সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি রাজনৈতিক আলোচনার সুযোগ পেলেই অংশ নিতাম এবং আমাদের দেশের মুক্তিসংগ্রামীদের সর্বদিক থেকে তৈরি করে দেশে পাঠিয়ে মুক্তিসংগ্রামকে পরিপূর্ণ রূপের দিকে নিয়ে যেতে নিরলসভাবে চেষ্টা চালাতাম। একবার নারায়ণগঞ্জ জেলার এক গ্রুপ রাজনৈতিক আলোচনা শুনে সারা রাত কেঁদেই অস্থির। তাদের বক্তব্য, আমরা তো যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে এসেছি, কিন্তু রাজনৈতিক-আদর্শিক যে আলোচনা শুনছি সমাজতন্ত্র ও গেরিলাযুদ্ধ সম্পর্কে, তা বাস্তবায়িত হলে আমাদের শিল্প, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, দুর্নীতি, চুরি, লুটপাট, এসবের কী হবে? এই গ্রুপ পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় শেখ কামালের প্রাইভেট বাহিনীতে যুক্ত হয়ে যেসব অপকর্ম করেছিল, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।

আমাদের রাজনৈতিক-আদর্শিক বিষয়বস্তু এক পর্যায়ে ভারতীয় সামরিক প্রশিক্ষকদের গোচরীভূত হয়। আমাদের প্রশিক্ষকদের সবাইকে ডেকে নিয়ে এসেম্বলী হলে একত্রিত করা হলো। জিজ্ঞাসা করা হলো, বিএলএফ-এর যোদ্ধাদের নাকি কমিউনিস্ট বানানো হচ্ছে- যা কেন্দ্রীয় ভারতীয় সরকারের নীতিবিরুদ্ধ। সেই যাত্রায় মাও সেতুঙ-এর একটি উদ্ধৃতি ও ওখানকার প্রশিক্ষকদের একটা উদ্ধৃতি বলে রক্ষা পেলাম। মাও সেতুঙ-এর উদ্ধৃতিটি ছিল : বিপ্লবী গেরিলা যুদ্ধে অস্ত্র যুদ্ধ করে না, অস্ত্রের পিছনে যে মানুষটি ও মানুষের পেছনে যে আদর্শটি তাই যুদ্ধ করে; সুতরাং আদর্শ হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কায়েম করতে হলে রাজনৈতিক আলোচনা ছাড়া বিকল্প নেই। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি ছিল: একজন কনভেনশনাল যোদ্ধা হবে রাফ, টাফ ও ফুল এবং একজন গেরিলা যোদ্ধা রাফ, টাফ ও ইন্টেলিজেন্ট; অর্থাৎ জনগণের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম হওয়ার লক্ষ্যে তাকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের তৎকালীন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের যে অংশটি বিএলএফ-এর মাধ্যমে তান্দুয়া ও হাফলঙে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তারাও সারা দেশে সবসময়ে প্রতিটি সংগ্রামের মধ্যে প্রধানত যে দুটো ধারা থাকে, তার থেকে কোনোক্রমে আলাদা ছিল না। একটি অংশ সুবিধাভোগী, সুবিধাবাদী ও আপসকামী; আরেকটি অংশ নিঃস্বার্থ, আদর্শবাদী ও আপসহীন। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক-ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করা গেলেও প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই ভারতের কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের উঠতি ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী গোষ্ঠীর পারস্পরিক স্বার্থে তার দফারফা হয়ে যায় । মাও একবার চীনের বিপ্লবী যোদ্ধাদের ক্ষমতা দখলের অস্থিরতা দেখে বলেছিলেন, দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী যুদ্ধ জনগণের সঙ্গে একাত্মতার মধ্য দিয়ে বিপ্লবী যোদ্ধাদের প্রকৃতই বিপ্লবী করে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামও একটা দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হলে বিএলএফসহ প্রকৃত যোদ্ধাদের সংগঠনসমূহ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একটা হতো, সকল শোষণ-শাসন থেকে বাঙালি জাতি ও মেহনতী জনগণকে মুক্ত করার ঐতিহাসিক কাজটির সূচনা ঘটাত। বিএলএফ সেই মুক্তিসংগ্রামে অবগাহন করে প্রকৃত শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্ম দিত। আধাশেঁচড়া স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে অপূর্ণ করে রাখল। সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী, আপসকামী বিএলএফ-এর যে ক্ষুদ্র অংশটি ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে থেকে প্রতিক্রিয়াশীল লুটেরা ভূমিকা পালন করেছে, তা-ই বিএলএফ নয়। বিএলএফ-এর প্রায় পুরো অংশটাই এখনও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম তথা বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পতাকাতলে জাসদ-বাসদ নামে সক্রিয়ভাবে লাগাতার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে চলছে। জনগণের বিজয় অবশ্যম্ভাবীভাবে জনগণই ছিনিয়ে আনবে। তৎকালীন বিএলএফ ও পরবর্তীকালে সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীরা ইতিহাস নির্দিষ্ট সত্য ও ন্যায়ের পথে মেহনতী জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভূমিকা রেখে যাবেন।

(মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক আ ফ ম মাহবুবুল হক জাসদ গঠনকালে অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। পরবর্তীকালে জাসদ ভেঙে বাসদ গঠনে নেতৃত্ব দেন। তার এই লেখাটি সংগৃহীত হয়েছে ২০০১ সালে গণপ্রকাশনী প্রকাশিত মেসবাহ কামাল সম্পাদিত “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা” বই থেকে।)
উৎস: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

Exit mobile version