বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই মারা গেছেন।
শুক্রবার (৯ জুন) দুপুর আড়াইটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রামণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
গত ৭ মে থেকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার। পরে ২০ মে তাকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়।
এর আগে ২০২১ সালে অসুস্থ হয়ে কিছুদিন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
স্বাধীনতালগ্নে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়।
তিনি কখনও নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকেন।
সিরাজুল আলম খান কখনও জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদের বই ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘ষাটের দশকে সিরাজুল আলম খানের উত্থান ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াতলে। এ সময় আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা মাঠ কাঁপিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ফারাক এক জায়গায়—তিনি ধারাবাহিকভাবে লেগে ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, শেখ মুজিবের ছয় দফা তাঁর বুকের মধ্যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। উনসত্তরে মুজিব যখন জেল থেকে ছাড়া পান, দেখলেন তাঁর জন্য জমি তৈরি হয়ে আছে, যার ওপর ভরসা করে বীজ বোনা যায়। জমি তৈরির এই কাজটি করেছেন সিরাজুল আলম খান। শেখ মুজিবকে নেতা মেনেই তিনি এটা করেছেন।’
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সিরাজুল আলম খান ষাটের দশকের সফল সংগঠন ছিলেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ক্ষমতার সঙ্গে শামিল হননি। ক্ষমতায় থাকলে তাঁর বিত্তবৈভব হতে পারত। তিনি তা করেননি। তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন।’
‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ বইটিতেই সিরাজুল আলম খান তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা বলেছিলেন। সেটি হলো, ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।’