সমুদ্রপথে কনটেইনার পরিবহনের পাশাপাশি জাহাজ ভাড়ায় মারাত্মক ধস নামলেও বাংলাদেশে পণ্যের দাম কমছে না। অথচ দুই বছর ধরে জাহাজ এবং কনটেইনার ভাড়া বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে ভোগ্যপণ্যসহ সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম দ্বিগুণ করা হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট বিশ্বমন্দার ফলে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের জাহাজ ভাড়ায় পাঁচ মাস ধরে মারাত্মক ধস নেমেছে। কাঙ্ক্ষিত পণ্য না পাওয়ায় প্রতিদিনই জাহাজ ভাড়ার পাশাপাশি কনটেইনার পরিবহন খরচ কমছে।
শিপিং এজেন্টদের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী ৪০ ফুট হাইকিউব প্রতিটি কনটেইনারের ভাড়া ১৮ হাজার মার্কিন ডলার হলেও এখন তা কমে মাত্র ২ হাজার মার্কিন ডলারে এসে থেমেছে। একইভাবে ইউরোপগামী কনটেইনারের ভাড়া ১৬ হাজার মার্কিন ডলার থেকে কমে নেমেছে মাত্র দেড় হাজার মার্কিন ডলারে। আর চীনগামী কনটেইনারের ভাড়া আগে তিন হাজার মার্কিন ডলার থাকলেও তা এখন ৪০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করেও পণ্যের বুকিং পাওয়া যাচ্ছে না।
এ নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, ‘বৈশ্বিক কারণে বাংলাদেশে আগে যেভাবে জাহাজে করে পণ্য আসত, এখন সব পণ্য আসছে না। কারণ, আমাদের এলসি (ঋণপত্র) সমস্যা ও ডলার সংকট রয়েছে।’
ইউরোপ-আমেরিকায় সরাসরি জাহাজ চলাচল ছাড়াও সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া এবং শ্রীলঙ্কাকে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করে পণ্য আনানেয়া করে বাংলাদেশ। আগে এসব ফিডার ভ্যাসেলে কনটেইনার ভাড়া ৫০০ মার্কিন ডলার হলেও এখন ২০০ থেকে ৩০০ ডলারে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। সাইফ মেরিটাইম লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার আবদুল্লাহ জহির বলেন, খালি কনটেইনারের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে জাহাজের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সে হিসেবে চাহিদা নেই। আর চাহিদা না থাকার কারণেই ভাড়া কমে গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই দেশের ৯২ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়ে থাকে আর রফতানি বাণিজ্যের ৯৮ শতাংশই সম্পন্ন হয় এ বন্দর দিয়েই। তাই জাহাজ এবং কনটেইনার পরিবহন ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। বছরে এখানে যেমন ৪ হাজারের বেশি জাহাজ আসছে, তেমনি কনটেইনার ওঠানামা করছে ৩২ লাখেরও বেশি। সাধারণত জাহাজ কিংবা কনটেইনারের ভাড়া বাড়লে এখানের পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া তুলনামূলক কম হলেও পণ্যের দাম কমছে না।
বাংলাদেশে তেল-চিনি-মসলা থেকে শুরু করে অধিকাংশ ভোগ্যপণ্য জাহাজ দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সে হিসেবে জাহাজ ভাড়া বাড়ার অজুহাতে গত দুই বছরে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম দু-তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখন জাহাজ ভাড়া কমলেও দেশের বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ২০২০ থেকে ২০২২ সালে প্রতি মণ সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৩ হাজার ৭০০ টাকা ও চিনির দাম ছিল ২ হাজার ৬০০ টাকা। যার দাম বাড়তে বাড়তে বর্তমানে মণপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম ৬ হাজার ৭০০ টাকা ও চিনির দাম ৪ হাজার ৬০০ টাকায় ঠেকেছে।
এ ক্ষেত্রে ডলার সংকটের পাশাপাাশি এলসি জটিলতার কথা উল্লেখ করে চট্টগ্রাম চাকতাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘ভাড়া কমলেও আমরা এর সুফল পাচ্ছি না।’
একই চিত্র রফতানি খাতের প্রধান উপকরণ গার্মেন্টস শিল্পেও। বৈশ্বিক মন্দার ফলে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ জাহাজ ভাড়া কমার সুযোগ পাচ্ছে না বলে দাবি করেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘ক্রয়াদেশ না থাকায় আমাদের রফতানি কমে গেছে। একই সঙ্গে আমদানিও কমে গেছে। এর জন্য বাধ্য হয়ে জাহাজ ভাড়া ও কনটেইনার ভাড়া কমিয়ে দেয়া হয়েছে।’
বিশ্বখ্যাত ১২ থেকে ১৫টি শিপিং লাইন বাংলাদেশে পণ্য পরিবহন করছে। তবে কাঙ্ক্ষিত পণ্য না পাওয়ায় কিছু কিছু শিপিং লাইন তাদের জাহাজের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে।