কৃষি প্রধান এই দেশে ঋতুর চক্রে যেমন ফসল আবর্তিত হয়, আর তাকে ঘিরেই আসে বিভিন্ন পার্বণ। আবার প্রতিটি পার্বণের সাথে জড়িয়ে আছে কোন না কোন ঐতিহাসিক বা পৌরানীক ঘটনা। বগুড়ার শেরপুরের ‘কেল্লাপোশী’ মেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। শত শত বছর ধরে চলে আসা এই মেলা কারও কাছে বিশ্বাসের আশ্রয়, কারও কাছে মিলন ক্ষেত্র আবার কারও কাছে আর্থিক সমৃদ্ধি। উদ্দেশ্যের ভিন্নতা থাকলেও প্রতিবছরের ন্যায় এবারও তিথি অনুযায়ি জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রবিবার প্রায় সপ্তাহব্যপী লাখো মানুষের ঢল নামবে এই মেলায়।
বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার কেল্লা ও পৌষী নামে দুই গ্রামের এলাকাজুড়ে বসে এই মেলা। তাই এর নামকরণ হয়েছে ‘কেল্লাপোশী’। স্থানীয় ভাবে এটা ‘জামাইবরণ’ মেলা নামে পরিচিত। নাম যাইহোক, এটা যে মেলার রাজা সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই।
এর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হচ্ছে এই বলে—
‘কেল্লাপোশী মেলার রাজা
মাদার পীরের চামর পূজা,
মেলা নয়তো, ঠেলার বাজার,
লোক জমে যায় হাজার হাজার,
মেলা নামের ফাঁক
কেবল কিচড় পাঁক।’
প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রোববার এ মেলা বসে। মুল মেলা চলে টানা তিন দিন আর মসলা, কাঠের আসবাবপত্র ও মাছের মেলা চলে আরও দুই দিন। তবে ইরি ধান কাটার পর থেকেই সবার মনে মেলা-মেলা ভাবের উদয় ঘটে। শুরু হয় প্রস্তুতি পর্বের। মেলার এক মাস আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা কাঠের আসবাবপত্র, কুমারেরা মাটির তৈজসপত্র, খেলনার দোকানীরাও কাঠ ও মাটির খেলনা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। এছাড়াও আশে পাশের গ্রামের লোজন তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে পৌছে দেন মেলার নিমন্ত্রণ।
কথিত আছে ১৫৫৬ সাল থেকে কেল্লাপোশীতে এ মেলা হয়ে আসছে। এর সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি গাজী পিরের কিচ্ছার ঐতিহ্য জড়িত। ‘গাজী পির’ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত না হলেও বাংলার পুথি ও পটে রয়েছে এর সরব উপস্থিতি। বিচিত্র সব বর্ণনা পাওয়া যায় সেখানে।
গাজী পির নিয়ে স্থানীয় কিচ্ছা অনুযায়ী, বৈরাগনগরের বাদশা সেকেন্দারের ছেলে ছিলেন গাজী মিয়া। আর কালু মিয়া ছিলেন তাঁর দত্তক পুত্র। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তাঁরা দুই ভাই রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির-সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণনগরে আসেন। কোন কোন ইতিহাসবেত্তাদের মতে, যশোর জেলার ঝিকরগাছার দুই মাইল পূর্বে অবস্থিত লাউজানি গ্রামের পূর্বের নাম ব্রহ্মণনগর। এই রাজ্যের রাজা ছিলেন মুকুট রায়। কথিত আছে মুকুট রায়ের জমিদারী পাবনা হতে সমুদ্র এবং ফরিদপুর হতে বর্ধমান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুকুট রায়ের প্রধান সেনাপতির নাম দক্ষিণ রায়। ব্রাহ্মণ রাজা মুকুটের ছিল সাত পুত্র ও এক কন্যা চম্পাবতী। বাংলা সাহিত্যে যা ‘সাত ভাই চম্পা’ নামে পরিচিত। চম্পাবতী গাজীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার কাছে যান।
মুকুট রাজা ছিলেন যবনদ্বেষী ব্রাহ্মণ। কালু ঘটক হিসেবে রাজা মুকুট রায়ের দরবারে গিয়ে গাজীর সঙ্গে চম্পাবতীর বিয়ের কথা উত্থাপন করলে কালু বন্দী হন। ফলে গাজীর সঙ্গে যুদ্ধ বাধল মুকুট রাজার। মুকুট রাজার কাছ থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য গাজী মিয়া কেল্লা ও পোশী গ্রামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। যুদ্ধে রাজা মুকুটের পরাজয় ঘটে। গাজী ও চম্পাবতী পরিণয়ে আবদ্ধ হন।
পুথির ভাষায়—
‘সাত শত গাড়ল লয়ে
দাবার ঘাট পার হয়ে
গাজী চললেন খুনিয়া নগর
খুনিয়া নগরে যেয়ে মুকুট রাজার মেয়ে
গাজী বিয়ে করলেন কৌশল্যা সুন্দরী।’
কথিত আছে, গাজী ও চম্পাবতীর এই পরিণয় হয়েছিল জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। তখন থেকেই চলে আসছে এ মেলা। স্থানীয়দের মতে এলাকার পেংহাজারকী গ্রামে মুকুট রায়ের প্রধান সেনাপতি দক্ষিণা রায়ের, জামুর গ্রামে মুকুট রাজার ও কুসুম্বী গ্রামে গাজী পীরের বাড়ির ধ্বংশাবশেষ এখনও আছে।
এই মেলা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে থাকে নানা আয়োজন। এরই একটি হচ্ছে মাদার খেলা। মেলা শুরুর সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে এ খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রঙে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার নানা সরঞ্জাম আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের পাড়া-মহল্লাতেও খেলা দেখায়।
মেলা শুরুর আগপর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা। জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার দলটি মেলা এলাকায় থাকা মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে এ খেলা শেষ করে। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটার ধুম। বহু দূর থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন।
এ মেলাকে ঘিরে আশপাশের গ্রামগুলোতে শুরু হয়েছে রকমারি আয়োজন। নতুন-পুরোনো বলে কথা নেই। মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনেন। বিশেষ করে নতুন জামাই-বউকে নিয়ে সবাই আনন্দে মেতে ওঠেন। শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে জামাইবাবুকে মোটা অঙ্কের সেলামিও দেওয়া হয়। সেই সেলামি আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাইবাবুরা মেলা থেকে খাসি কিনে শ্বশুরবাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন, বড় মাছ, মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা ও কিনে আনেন তাঁরা।
প্রতিবারের ন্যায় মেলায় শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন। এ প্রসঙ্গে শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবু কুমার সাহা বলেন, ‘যেহেতু মেলাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঘটে, তাই সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।’