থাইল্যান্ডে যে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তাতে রীতিমতো চমক দেখিয়েছে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি) নামে স্বল্প পরিচিত একটি দল। তারুণ্যের সমন্বয়ে গঠিত দলটির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হলেন পিটা লিমজারোয়েনরাত। মাত্র ৪২ বছর বয়সেই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে বাজিমাত করেছেন তিনি।
রোববার (১৪ মে) থাইল্যান্ডে পার্লামেন্ট নির্বাচিত অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি) চমকপ্রদ ও আশাতীত ফল করেছে। থাই ভোটাররা প্রায় এক দশকের সেনা-সমর্থিত শাসন ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যানই করেনি, নির্বাচনে অংশ নেওয়া অন্যান্য দলের তুলনায় একেবারেই নতুন একটা দল এমএফপিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
শুধু তাই নয়, ভোটের এই জোয়ারে তার প্রধানমন্ত্রিত্বও অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। এর কয়েক ঘণ্টা পর সোমবার (১৫ মে) ব্যাংককে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলন করেন পিটা লিমজারোয়েনরাত। শত শত সাংবাদিক ও আর ক্যামেরা ঘেরা এক কক্ষে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আজ নতুন একটা দিন। আশা করি দিনটা উজ্জ্বল রোদ আর আশায় ভরপুর হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুগের চেতনা-আবেগ বদলে গেছে। আর এটাই ছিল সঠিক সময়।’ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ৫০০টি আসন। তার মধ্যে ১৫১টিই জিতেছে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি। ব্যাংককের ৩৩টি আসনের মধ্যে ৩২টিতেই জয়ী এমএফপির প্রার্থীরা।
সরকার গঠনের কাজ শুরু হতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। এক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলাও হতে পারে। কারণ থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর এখনও যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। তবে নির্বাচনে বিশাল জয় পিটা ও তার দলকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
আর পিটা দেশের তরুণ ভোটারদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করেছেন যারা বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসনের কারণে হতাশ ও একই সঙ্গে পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে ছিল।
পিটার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু ২০১৯ সালে। ফিউচার ফরওয়ার্ড পার্টির সদস্য হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা বিলিয়নিয়ার ও সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক থানাথর্ন জুয়াংগ্রুংগ্রুয়াংকিত। দলটি ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভালো ফল করে। যা থাই রাজনীতিতে ব্যাপক কম্পন সৃষ্টি করে।
কিন্তু বিতর্কিত কিছু অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে ফিউচার ফরোয়ার্ডকে ভেঙে দিতে বাধ্য করা হয়। একই সঙ্গে থানাথর্নকে সংসদ সদস্য হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এরপরই মুভ ফরোয়ার্ড নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। পিটা হন সেই দলের নতুন নেতা।
নিষেধাজ্ঞার পরও সেই বছর থাইল্যান্ডে হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নামে। সংবিধান সংশোধন, নতুন নির্বাচন ও মানবাধিকার কর্মী ও সরকারের সমালোচকদের হয়রানি বন্ধের দাবি জানান তারা।
সাধারণ জনগণের পরিবর্তনের সেই আকাঙ্ক্ষা এবারের নির্বাচনে মুভ ফরোয়ার্ডের জয়ে বড় অবদান রেখেছে। নির্বাচনে ২০২০ সালের আন্দোলনে অংশ নেয়া কয়েকজন প্রতিবাদী নেতাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
বয়সে তরুণ হলেও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পিটা মূলত একজন সংস্কারবাদী ও দৃরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক। সংসদে বিরোধীদলীয় সদস্য হিসেবে সরকারের তীব্র সমালোচনা করে উদীয়মান তারকা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি। এছাড়াও তিনি সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব ও রাজতন্ত্র সম্পর্কিত আইন সংস্কারের সাহসী প্রতিশ্রুতি দিয়েও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
নির্বাচনের পরদিন সোমবার (১৫ মে) অতীতের সেই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করে পিটা বলেন, ‘মুভ ফরওয়ার্ড রাজতন্ত্র সম্পর্কিত আইনের সংস্কার কাজ এগিয়ে নেবে। আমরা এই সংসদে আইনটি পাস করব। আমরা রাজতন্ত্র এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কীভাবে আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত, সেটি নিশ্চিত করতে সংসদকে ব্যবহার করব। অত্যন্ত স্বচ্ছতা ও বিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে এটি করা হবে।’
পিটার জন্ম থাইল্যান্ডের এক ধনাঢ্য পরিবারে। তার বাবা দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন। তার চাচা সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সহযোগী ছিলেন। ধনী পরিবারের সন্তান পেটার ছাত্রজীবন শুরু হয় নিউজিল্যান্ডের একটি হাইস্কুলে। পড়াশুনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।
পিটা জানান, হাইস্কুলে পড়ার সময় রাজনীতি নিয়ে তার আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর ব্যাংককের থামমাসাট ইউনিভার্সিটি থেকে ফাইন্যান্সে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন পিটা। বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তর ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
তবে চাকরির বদলে তার কর্মজীবন শুরু হয় ব্যবসা দিয়ে। প্রথমে প্রয়াত বাবার রাইস ব্র্যান অয়েল কোম্পানির পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এরপর রাইড-শেয়ারিং কোম্পানি গ্র্যাবের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।