আল-নাকবা বা মহাবিপর্যয়। ফিলিস্তিনের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিনগুলোর একটি। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইহুদিবাদী ইসরাইলি আধাসামরিক, সামরিক বাহিনীর হামলায় কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল আরও কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি। এর পর থেকে ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে ইসরাইলি বসতি গড়েছে।
আল-নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের সময় ফিলিস্তিনের বড় বড় শহর বা গ্রামে হামলা চালিয়েছিল ইসরাইলি আধাসামরিক বাহিনী হাগানা এবং ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর হামলায় বিপর্যস্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে বালাদ আল-শেইখ, সাসা, দিয়ার ইয়াসিন, সালিহা এবং লিদ্দা অন্যতম। সংক্ষেপে এসব শহর বা গ্রামে ইসরাইলি হামলা-নৃশংসতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
বালাদ আল–শেইখ
১৯৪৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ইসরাইলি হাগানা বাহিনী বালাদ আল-শেইখে বড় ধরনের হামলা চালায়। এই হামলায় অংশ নেয় হাগানার এলিট ফোর্স পালমাখ। এদিনের হামলায় কয়েক শ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। ফিলিস্তিনি পুরুষদের ধরে ধরে হত্যা করা হয় এদিন। কেবল পুরুষরাই নয়, হাগানা এবং পালমাখের হামলা থেকে নারী-শিশুও রেহায় পায়নি সেদিন।
সেদিনের নৃশংস হামলার পর ১৯৪৮ সালের ৭ জানুয়ারি নাগাদ অধিকাংশ ফিলিস্তিনি বালাদ আল-শেইখ ছেড়ে চলে যায় এবং সে বছরের এপ্রিল নাগাদ ইসরাইলি বাহিনী এলাকাটির পরিপূর্ণ দখল নেয়। এর আগে, বালাদ আল-শেইখ ধর্ম প্রচারক ইজ্জুদ্দিন আল-কাসেমের সমাধির জন্য বহুল পরিচিত ছিল। সে সময় শহরটি ফিলিস্তিনের অন্যতম বড় শহর ছিল।
সাসা
এই শহরটিতে দুই দফায় গণহত্যা চালায় হাগানা। একটি ১৯৪৮ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে এবং অপরটি সে বছরের অক্টোবরে। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে পালমাখ সাসায় গণহত্যা চালায়। বেশ কয়েকটি বাড়িতে বিস্ফোরক বসিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দেয়। এসময় বিপুল পরিমাণ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে শিশুও ছিল।
দ্বিতীয় গণহত্যাটি সংঘটিত হয় অক্টোবরের ৩০ তারিখে। এদিন কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে হাগানাও কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে সেই হামলার পর পুরো গ্রামটি ফিলিস্তিনিশূন্য হয়ে যায়।
দিয়ার ইয়াসিন
১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল। ফিলিস্তিনের ইতিহাসের অন্যতম শোকের দিন। এদিন অন্তত ১১০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে স্রেফ কচুকাটার মতো করে হত্যা করা হয়। জেরুজালেমের পশ্চিম উপকণ্ঠে অবস্থিত দিয়ার ইয়াসিনে সংঘটিত এই গণহত্যায় ইসরাইলিরা অর্ধশতাধিক নারী-শিশুকেও হত্যা করে।
হত্যা করা ছাড়াও যাদের বন্দী করা হয়েছিল, তাদের সবাইকে বেধে সারিবদ্ধভাবে জেরুজালেম নগরী ঘোরানো হয়েছে। ঘোরাতে বাধ্য করেছে ইসরাইলি বাহিনী। পরে এদের সবাইকেই হত্যা করা হয়। কাউকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আবারও কাউকে জেরুজালেম শহরের বাইরেই।
ইসরাইলি দখলের আগে, দিয়ার ইয়াসিন গ্রামটিতে ১৪৪টি ঘরে সাড়ে ৭০০ বাসিন্দা ছিল। কিন্তু ভয়াবহ সেই গণহত্যার পর হঠাৎ করেই জনশূন্য হয়ে যায় গ্রামটি এবং ইসরাইলিরা দখল করে নেয়।
সালিহা
ইসরাইলি নৃশংসতার আরেকটি উদাহরণ সালিহা শহরটি। ১৯৪৮ সালের ৩০ অক্টোবর ইসরাইলি সেনাবাহিনীর শেভা ব্রিগেড বা সেভেন্থ ব্রিগেড ব্যাপক গণহত্যা চালায়। সেদিন সেনারা গ্রামটিতে ঢুকে ঘরবাড়ি উড়িয়ে দিতে থাকে। ভয়ে লোকজন স্থানীয় একটি মসজিদে আশ্রয় নিলে সেখানেও আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। সেখানেই ঘটনাস্থলে ৬০ থেকে ৯৪ জনের মৃত্যু হয়।
২০০৮ সালের এক হিসাব বলছে, সে সময় সালিহা থেকে কমপক্ষে ৮ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল।
লিদ্দা
১৯৪৮ সালের জুলাইয়ের ৯ তারিখে লিদ্দা শহরটিতে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায় ইসরাইলি বাহিনী। সেই অভিযানের নাম ছিল অপারেশন দানি। লিদ্দা ছাড়াও রামলা নামের আরেকটি শহরে জুলাইয়ের ৯ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত ক্রমাগত অভিযান চালানো হয়। সেই অভিযানে মারা যায় কয়েক শ ফিলিস্তিনি। তবে ইতিহাসবিদ সালমান আবু সিত্তার হিসাব অনুসারে সেসময় দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল।
এ ছাড়া ইসরাইলি আক্রমণে ভীত হয়ে যারা মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের স্রেফ কচুকাটা করা হয়েছিল। মেশিন গান, গ্রেনেড এবং রকেটের মতো অস্ত্র ব্যবহার করে তাদের হত্যা করা হয়েছিল মসজিদের ভেতরেই। ইতিহাসবিদদের ধারণা, সেদিন ৮০ থেকে ১৭৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল দাহমাশ নামক সেই মসজিদে ইসরাইলি হামলায়।
পরে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের সরাসরি নির্দেশে শহর দুটি থেকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করা হয়।