‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’- উক্তিটির বড় উদাহরণ হতে পারেন যশস্বী জয়সওয়াল, রিংকু সিংরা। এক সময় যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো, স্বপ্নকে তাড়া করে আজ তারা হয়েছেন আইপিএল তারকা। একবেলার খাবারের ব্যবস্থা করতে যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো আজ তারা কোটি টাকার মালিক।
অর্থ আর তারকা খ্যাতির দিক থেকে ক্রিকেট বিশ্বের এখন সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ আইপিএল। অনেক ক্রিকেটারের কাছে জাতীয় দলের চেয়ে বড় স্বপ্ন এই লিগটাতে খেলতে পারা। সে আইপিএলে গত ৩০ এপ্রিল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বোলারদের তুলোধুনো করে স্মরণীয় এক ইনিংস খেলেছেন ভারতের তরুণ ক্রিকেটার জয়সওয়াল। মাত্র ৬২ বলে তার তাক লাগানো ১২৪ রানের ইনিংসটি সাজানো ছিল ১৬ চার ও ৮ ছক্কার মারে। আইপিএল ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া এ ক্রিকেটার ইনিংসটির মাধ্যমে নাম লেখিয়েছেন নতুন এক রেকর্ডে। ফ্র্যাঞ্চাইজিটির ইতিহাসে ‘আনক্যাপড’ (এখনো জাতীয় দলের হয়ে খেলেননি যারা) খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস এখন তার। শুধু ওই ম্যাচেই নয়, চলতি আসরের শুরু থেকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে এ টপ অর্ডারের ব্যাট। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ১০ ইনিংসে ৪৪.২০ গড়ে ১৫৮.৪২ স্ট্রাইকরেটে ৪৪২ রান করে ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।
২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে রাজস্থান রয়্যালসের নজরে আসেন জয়সওয়াল। তাকে ওই বছর ২ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে কিনে নেয় ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। এরপর থেকেই আছেন দলটির সঙ্গে। তবে জয়সওয়ালের ক্রিকেট জীবনের উত্থানটা এতটা সুখকর ছিল না। রাতারাতি তিনি তারকা বনে যাননি। স্বপ্নপূরণে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ।
জয়সওয়ালের জন্ম ভারতের উত্তরপ্রদেশের ভাদোহি জেলায়। বাবা ভুপেন্দ্র রং বিক্রি করতেন। বেসরকারি স্কুলে পড়াতেন মা কাঞ্চন। চার সন্তানের লালন-পালনের পর জয়সওয়ালের ক্রিকেটার বানানোর খরচ জোগানো অসম্ভব হয়ে উঠছিল। কিন্তু ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ ছিলেন জয়সওয়াল। তাই অভাব অনটনকে একপাশে রেখে বাবাকে বুঝিয়ে দশ বছর বয়সেই পাড়ি দেন মুম্বাইয়ে। পেট চালাতে প্রথমে একটি দোকানে কাজ নেন। কিন্তু ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নপূরণে দোকানের চেয়ে অনুশীলনে বেশি সময় দিতেন তিনি। যার কারণে সেখান থেকে চাকরি হারান তিনি। এরপরও অনুশীলন বন্ধ করেননি তিনি। কিন্তু স্বপ্নপূরণের জন্য টাকাও তো দরকার। অনেক মাথা খাটিয়ে ফুচকা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। আর কারও কাছে কৈফিয়ৎ দেয়ার নেই। কাজের বাঁধাধরা নিয়ম, সময় নেই। ফুচকা বিক্রির বাইরে বাকিটা সময় মনোযোগ দিতেন ক্রিকেটে। থাকতেন অনুশীলনের সময় পরিচয় হওয়া মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানের এক মাঠ কর্মীর সঙ্গে। দুজনকেই অবশ্য রাত কাটাতে হতো তাঁবুতে। সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না, খাওয়ার পানি ছিল না। বলা যায়, সকল নাগরিক সুবিধার বাইরে থাকতে হয়েছে। এরমধ্যেও জয়সওয়াল বিভোর ছিলেন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে।
একদিন অনুশীলনের সময় তার প্রতিভা চোখে পড়ে মুম্বাইয়ের কোচ জ্বালা সিংয়ের। ঘুরে যায় জীবনের গতিপথ। জয়সওয়ালকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন জ্বালা। মুম্বাইয়ের সান্তাক্রুজে নিজের অ্যাকাডেমি রয়েছে জ্বালার। সেখানে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান জয়সওয়াল। সেই শুরু। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০১৫ সালে স্কুল ক্রিকেটে তার ৩১৯ রানের ইনিংস এবং ৯৯ রান দিয়ে ১৩ উইকেট জায়গা করে নেয় লিমকা বুক অব রেকর্ডসে। সুযোগ চলে আসে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে। ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও। এরপর ২০২০ সালে যুব বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার। ১৩৩ গড়ে টুর্নামেন্টে ৪০০ রান। সেমিফাইনালে ম্যাচ-জেতানো সেঞ্চুরি ও চারটি হাফ-সেঞ্চুরির অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা। তারপর আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজির নজরে। এরপর আজকের আইপিএল তারকা।
এমন সংগ্রামের গল্প আছে আইপিএলের আরেক তারকা রিংকু সিংয়েরও। কলকাতা নাইট রাইডার্সের এ ব্যাটার গত ৯ এপ্রিল গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে শেষ ওভারের শেষ পাঁচ বলে ৫ ছক্কা হাঁকিয়ে আইপিএলে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছেন। ২১ বলে ১ চার ও ৬ ছক্কায় ৪৮ রানে অপরাজিত থেকে সেদিন দলকে অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়েছিলেন রিংকু। এরপরই তাকে নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। ওই ম্যাচের পর তার ব্যক্তিগত জীবন এবং ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প লেখালেখি হতে থাকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে। ভারতের উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ের একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান রিংকু। ৫ ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ছোট থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের যাত্রাপথ মোটেই মসৃণ ছিল না। বরং ক্রিকেটার হওয়াটা তার কাছে একটা সংগ্রাম ছিল।
রিংকুদের অভাবের সংসার। তার বাবা বাড়ি বাড়ি এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার বিলি করতেন। এক ভাই অটোচালক। অন্য এক ভাইয়ের কোচিং সেন্টার রয়েছে। পড়াশোনাতেও ভালো ছিলেন না রিংকু। নবম শ্রেণিতে অকৃতকার্য হওয়ার পর আর স্কুল যাননি। টানাটানির সংসারে দু’বেলা খাবারের জন্য রিংকুকে ঝাড়ুদারের কাজে লাগিয়েছিলেন তার ভাই। টাকা উপার্জনের জন্য কাজের দরকার ছিল ঠিকই, কিন্তু ঝাড়ুদার হতে চাননি রিংকু। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ রিংকু। একদিন কাজ থেকে বাড়ি ফিরে তার মাকে জানিয়েছিলেন, ঝাড়ুদার নন, ক্রিকেটার হতে চান তিনি।
অভাবকে একপাশে রেখে পূর্ণ মনোযোগ দেন ক্রিকেটে। পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের এক পর্যায়ে রিংকুর সামনে সুযোগ আসে। তখন তার বযয় ১৭ বছর। প্রথমবার উত্তরপ্রদেশ রাজ্য ক্রিকেট দলে খেলার সুযোগ পান। ২০১৪ সালে নিজের রাজ্যের হয়ে লিস্ট এ ম্যাচ খেলেন রিংকু। সেখানে ৮৩ রানের ইনিংস খেলে নজর কাড়েন তিনি। এরপর ২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় রিংকুর। প্রথম ৭টি লিস্ট এর ম্যাচে ৪টি অর্ধশতরান করেছিলেন তিনি, যা দেখে অনেকেই তার প্রতিভা আঁচ করতে পেরেছিল।
তাতে ২০১৭ সালে তিনি সুযোগ পেয়েছেন বহুল আকাঙ্ক্ষিত আইপিএলে। ১০ লাখ রুপিতে তাকে কিনেছিল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। তবে সে বার টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পাননি তিনি। পরের বছর তাকে ৮০ লাখ রূপি খরচে দলে ভিড়িয়ে নেয় কলকাতা নাইট রাইডার্স। এরপর থেকে সেখানেই খেলে যাচ্ছেন টানা পাঁচ আসর। তার প্রতি ভরসার রাখার ফলও পাচ্ছে কলকাতা। যখনই ব্যাট করার সুযোগ পাচ্ছেন কাঁপুনি ধরাচ্ছেন প্রতিপক্ষের বোলারদের। চলতি আসরে এখন পর্যন্ত ১০ ইনিংসে ৫২.৬৬ গড়ে ও ১৪৮.৩৫ স্ট্রাইকরেটে করেছেন ৩১৬ রান। যেখানে আছে তার দুটি ফিফটির ইনিংসও।