Homeআন্তর্জাতিকআল-আকসায় কেন ইসরাইলি তাণ্ডব

আল-আকসায় কেন ইসরাইলি তাণ্ডব

এবার পবিত্র রমজান মাসেই অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে তাণ্ডব চালিয়েছে ইসরাইল। মসজিদের ভেতরে ঢুকে নামাজরত ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের ওপর হামলা করেছে, ছুড়েছে টিয়ার গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড।

ইসরাইলের নিরাপত্তা বাহিনী মুসল্লিদের নির্বিচারে মারধর করছে-এমন একটি ভিডিও ফুটেজ বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে এসেছে। ইসলামের তৃতীয় সর্বোচ্চ এ পবিত্র স্থানে ইসরাইলি বাহিনীর চালানো ওই নৃশংস ও এই ন্যাক্কারজনক হামলায় কমপক্ষে ১২ জন ফিলিস্তিনি গুরুতর আহত হন। আটক কর হয় আরও শতাধিক ফিলিস্তিনিকে যা পুরো ফিলিস্তিনকে আতঙ্কিত করে তোলে।

এ ধরনের হামলা হলে সহিংসতা বাড়বে- এমন সতর্কতা আগেই অনুমিত ছিল। হামলার প্রতিক্রিয়ায় অধিকৃত গাজা উপত্যকা ও লেবানন থেকে ইসরাইলে রকেট ছোঁড়া হয়। তবে ইসরাইল তাতে কর্ণপাত করেনি। পরদিন ইসরাইলি বাহিনী আল-হারাম আল-শরিফে (আল-আকসা মসজিদের একটি চত্বর) আবারও হামলা চালায়। এমনকি গাজা ও লেবাননেও বিমান হামলা চালায়।

আল-আকসায় ইসরাইলের এমন বর্বরোচিত হামলা নতুন নয়। আর এসব হামলার প্রধান কারণ ইসরাইলি নেতাদের গোয়ার্তুমি ও তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির মাধ্যমে এটা পরিস্কার যে, ফিলিস্তিনে নতুন করে উত্তেজনা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। নতুন এ উত্তেজনার জন্য ফিলিস্তিনিরা কোনোভাবেই দায়ী নয়।

ওয়াশিংটনের হয়ত মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমানোর সদিচ্ছা আছে। তবে ইসরাইলের কট্টর ডানপন্থি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার মরিয়া চেষ্টার কাছে ওয়াশিংটনের সেই ইচ্ছা পাত্তা পাচ্ছে না। এখন নেতানিয়াহু ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য যেকোনো কিছুই করতে পারেন। যা শেষ পর্যন্ত অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের বাইরেও সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ব্যর্থ মার্কিন কূটনীতি

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিপরীতে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামগুলোতে অব্যাহত অভিযান চালিয়ে আসছে।

২০২২ সালে ৩০ জন শিশুসহ কমপক্ষে ১৭০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এছাড়া ইসরাইলের হামলায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯ হাজার। জাতিসংঘ এ বছরটিকে গত ১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক বলে উল্লেখ করেছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম দুইমাসে ইসরাইলের হামলায় ১৩ শিশুসহ ৬৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

চলতি বছর ফিলিস্তিনি মুসলিমদের পবিত্র রমজান আর ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব পাসওভার বা পেসাচ দিবস একই সময়ে পড়ে। যে কারণে আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল যে, বছরের এ সময়টি সহিংসতার জন্য আরেকটি সম্ভাব্য ফ্ল্যাশপয়েন্ট হবে।

ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেবে এমন একটি বড় বৃদ্ধি উত্তেজনা রোধ ও পরিস্থিতি শান্ত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে দুটি আঞ্চলিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জর্ডানের বন্দর শহর আকাবায় ফিলিস্তিনি, ইসরাইল, জর্ডান, মিশর ও মার্কিন কর্মকর্তারা বৈঠকে মিলিত হন। শীর্ষ সম্মেলনের পরে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সবপক্ষ উত্তেজনা প্রশমনে ও ভবিষ্যতের সহিংসতা বন্ধে জোর দিয়েছে এবং পরবর্তী ছয় মাস ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কোনো অবৈধ বসতি স্থাপনার অনুমোদন দেবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

পরে ১৯ মার্চ মিশরের শারম আল-শেখ-এ আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলের কর্মকর্তারা জেরুজালেমের পবিত্র স্থানগুলোর মর্যাদা ‘কথায় ও কাজে’ বজায় রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

কিন্তু নেতানিয়াহুর সরকার না কথায় বা না কাজে কোনোভাবেই জেরুজালেম শহরের মর্যাদা রক্ষা করেনি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এমন উগ্র ইহুদি ধর্মীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ, যারা প্রকাশ্যে বলে থাকে, পবিত্র স্থাপনাগুলোকে জর্ডানের তত্ত্বাবধানে দেয়ার বিষয়টিকে ইসরাইলির স্বীকৃতি দেয়া একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল এবং সেই ‘ভুল’ ইসরাইলকেই ‘শোধরাতে হবে’।

ইসরাইলের চরম উগ্র ডানপন্থি ইহুদিবাদী নেতা ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের আল-হারাম আল-শরিফে উসকানিমূলক প্রবেশ দিয়ে ২০২৩ সাল শুরু হয়। মূলত তার তত্ত্বাবধানে ও উসকানিতেই আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর হামলা চালায় ইসরাইলের সেনারা।

ধর্মযুদ্ধ

এটা বেশ পরিস্কার যে, যুদ্ধ ইসরাইলের স্বার্থ নয়। কারণ ষষ্ঠ দফায় ক্ষমতায় আসার পর ইসরাইলের জনগণ নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করছে, তা থেকে দৃষ্টি এই দিকে সহজেই ঘুরে যাবে। এটি মোটামুটি দৃশ্যমান যে বাইরের দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করা ইসরাইলের আগ্রহের বিষয় নয়। ইসরাইল বর্তমানে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সামলানো নিয়ে ব্যস্ত আছে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামরিক উপস্থিতি ও কূটনৈতিক সাফল্য নিয়ে তারা চিন্তিত। লেবানন সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় সম্প্রতি যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তাতে হিজবুল্লাহর সম্পৃক্ততাও ইসরাইলকে চিন্তায় ফেলেছে। তবে নেতানিয়াহু ইসরাইলি নিরাপত্তা সংস্থার কথা শুনবেন কি না তা অন্য প্রশ্ন।

অন্যদিকে হামাস পশ্চিম তীর, জেরুজালেম ও ইসরাইলে বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ করার পরিকল্পনা করায় ইসরাইল চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আল-আকসায় যাতে ইসরাইলের বাহিনী ঢুকতে না পারে, সেজন্য বিপুলসংখ্যক মুসল্লিকে হামাস জড়ো করতে চায়।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে জর্ডানের রাষ্ট্রদূত মাহমুদ দাইফাল্লাহ হামুদ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, আল-হারাম আল-শরিফের ওপর ইসরাইলি হামলা ‘প্রায় দুই বিলিয়ন মুসলমানদের অনুভূতিকে উসকে দিচ্ছে যা একটি ‘ধর্মীয় সংঘাত’ সৃষ্টি করতে পারে।

অনেকে এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, নেতানিয়াহুর সরকার হয়তো এই আগ্রাসী হামলা দিয়ে আল-আকসায় ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে চায়, যেটি তারা হেবরন শহরের (আগের নাম আল খলিলি) ইব্রাহিমি মসজিদের ক্ষেত্রে করেছিল।

১৯৯৪ সালে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ইব্রাহিমি মসজিদে নামাজরত ২৯ মুসল্লিকে হত্যা করার পর ইসরাইল ‘অধিকতর সহিংসতা ঠেকাতে’ মসজিদটিকে মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে দুই ভাগ করে দিয়েছিল।

আল-আকসা প্রাঙ্গণেও এ ধরনের ব্যবস্থা আরোপ করা হলে মুসলমানদের পবিত্র উপাসনালয়ের মর্যাদা হারাবে। এবং সেটি হলে মুসলমানরা শুধুমাত্র অনুমতি সাপেক্ষে কিছু সময়ের জন্য ঢুকতে পারবে, কিন্তু ভেতরে নামাজ পড়তে পারবে না। এ পরিস্থিতিতে আল–আকসাকে গ্রাস করে ফেলা সহজ হবে।

আল-আকসা মসজিদে ইসরাইলি হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত আরব লীগ, ওআইসি, জাতিসংঘ, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশ ও সংগঠন নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এক্ষেত্রে আরব রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় হতে হবে। অন্যথায় নেতানিয়াহুর উগ্র-ডানপন্থিরা আল-আকসা থেকে মুসলমানদের পবিত্র স্থানগুলো থেকে বিতাড়িত করতে আরও সাহসী হয়ে উঠবে। যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সর্বশেষ খবর