‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’—গত বছর ব্যালন ডি’অর জয়ের পর করিম বেনজেমার জীবনে প্রাসঙ্গিকভাবে ফিরে এসেছিল চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের এই গানটি। কণ্টকাকীর্ণ এক পথ পেরিয়ে এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামের বিশালকার এক নক্ষত্রের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে গত মৌসুমে বেনজেমা নিজের গল্পটা লিখেছিলেন রূপকথার মতো করে। মৌসুমটি ছিল মূলত একজন পার্শ্বনায়কের নায়ক হয়ে ওঠার। দৃশ্যের আড়ালে চলে যাওয়ার পথেই ছিলেন বেনজেমা। কিন্তু লড়াইয়ের বীজ যাঁর রক্তে, তিনি বিনা যুদ্ধে হার মানবেন কেন! বেনজেমাও মানেননি। বীরদর্পে ফিরে এসে ফুটবল মঞ্চে উড়িয়েছেন নিজের সাফল্যের পতাকা। তাঁর হাত ধরেই রিয়াল মাদ্রিদ জিতেছে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা।
কিন্তু নজরুলের সেই লাইনটাকেই যেন নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন বেনজেমা, ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ বেনজেমারও যায়নি, যাচ্ছে না। সাফল্যের গল্প ফিকে হয়ে আসে নতুন মৌসুমের শুরুতে। পারফরম্যান্সের ঘাটতি নয়, চোটের হানাতেই মূলত নাকাল হয়ে পড়েছিলেন বেনজেমা। সেই চোট কেড়ে নিয়েছে তাঁর বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নও। এরপর ফ্রান্স দলের কোচ দিদিয়ের দেশমের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে অভিমানে অবসরও ঘোষণা করে দেন বেনজেমা। রিয়ালের জার্সিতেও আগের মৌসুমের সেই অপ্রতিরোধ্য বেনজেমাকে যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বেনজেমাকে ঠিকঠাকভাবে না পেয়ে রিয়ালও লিগ রেসে পিছিয়ে পড়ে অনেকটা।
তবে মৌসুমের শেষ ভাগে এসে ঠিকই পাশার দান বদলে দিতে শুরু করেছেন বেনজেমা। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে যেকোনো প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যাওয়ার কথা। সর্বশেষ ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে রিয়ালের ৩–২ গোলে হারা ম্যাচে ৫৯ মিনিটে তাঁকে নামিয়ে নেন কোচ কার্লো আনচেলত্তি। মূলত চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচের আগে বেনজেমাকে নিয়ে ঝুঁকি এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নেন আনচেলত্তি। সেই ম্যাচটি বাদ দিলে আগের দুই ম্যাচে টানা দুই হ্যাটট্রিক করে বেনজেমা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি ফিরে এসেছেন। এমনকি লিভারপুলের বিপক্ষে শেষ ষোলোর দুই ম্যাচেই গোল পেয়েছেন এই স্ট্রাইকার। প্রথম লেগে করেছিলেন জোড়া গোল। আর এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে বেনজেমার ফিরে আসা যেকোনো শক্তিশালী রক্ষণের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে যথেষ্ট।
সেরা ছন্দে থাকা বেনজেমার ফিরে আসাটা কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা রিয়ালের আজকের ম্যাচের প্রতিপক্ষ চেলসির চেয়ে ভালো কে আর জানে! গত মৌসুমে শেষ আটের প্রথম লেগে চেলসির মাঠে হ্যাটট্রিক করে রিয়ালকে এনে দিয়েছিলেন ৩–১ গোলের জয়। আর দ্বিতীয় লেগে রিয়াল যখন ৩–০ গোলে পিছিয়ে থেকে বিদায়ের অপেক্ষায় ছিল, তখন রিয়ালকে সেমিফাইনালে নিয়ে গিয়েছিল বেনজেমার ৯৬ মিনিটে করা এক গোল। সেদিন শেষ পর্যন্ত জিতেও হেরে গিয়েছিল চেলসি। যে হারের ক্ষত হয়তো এখনো নিশ্চয় ভুলতে পারেনি ব্লুজরা। এবার রিয়ালকে হারিয়ে নিশ্চয় সেদিনের বিদায়ের ক্ষতে প্রলেপ দিতে চাইবে ইংল্যান্ডের ক্লাবটি। কিন্তু এবারও স্টামফোর্ড ব্রিজের দলটির সবচেয়ে বড় হুমকির নাম সেই বেনজেমা।
সে (বেনজেমা) জ্বলে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বিরতিতে কাজ করে সে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। পার্থক্য গড়ে দেওয়ার জন্য সে এখন বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। কার্লো আনচেলত্তি, রিয়াল মাদ্রিদ কোচ
বেনজেমার ছন্দে ফেরা চেলসি শিবিরে ভীতি ছড়ালেও রিয়ালকে করে তুলেছে দারুণ আত্মবিশ্বাসী। টানা দুই হ্যাটট্রিকের পর রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি তো বেনজেমার ব্যালন ডি’অর ধরের রাখার সম্ভাবনার কথাও বলেছেন। বার্সেলোনার বিপক্ষে কোপা দেল রের সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিক করে রিয়ালকে জেতানোর পর বেনজেমা ব্যালন ডি’অর ট্রফি ধরে রাখতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আনচেলত্তি বলেছেন, ‘কেন নয়? সে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার, ফরোয়ার্ড নয়, আমি বিশ্বের সেরা ফুটবলারের কথা বলেছি। সে যখন ফিট থাকে, পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।’চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচের আগেও বেনজেমাকে নিয়ে আলাদা করে কথা বলেছেন আনচেলত্তি। ফরাসি তারকার ছন্দে ফেরা যে তাঁকে বাড়তি স্বস্তি দিচ্ছে, সেটিই যেন ফুটে উঠল আনচেলত্তির কণ্ঠে, ‘সে জ্বলে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বিরতিতে কাজ করে সে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। পার্থক্য গড়ে দেওয়ার জন্য সে এখন বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে।’
আনচেলত্তির ভালোই জানা আছে রিয়ালের শিরোপা ধরে রাখতে হলে বেনজেমাকে তাঁর কতটা প্রয়োজন। তাই মৌসুমের গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে বেনজেমার জ্বলে ওঠা ইতালিয়ান কোচের আত্মবিশ্বাসের পালেও বাড়তি হাওয়া দিচ্ছে। অন্যদিকে চেলসিও জানে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম বেনজেমা। এখন ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের ভাঙাচোরা দলটি পেয়ে বেনজেমা নতুন কোনো তাণ্ডব করে বসেন কি না, সেদিকেই চোখ থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের।