সাহিত্যের অন্যতম একটি ধারা রোমান্টিসিজম। অনেকের মতে, এ থেকেই উৎপত্তি রোমান্টিকতা বা রোমান্সের ধারণা। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। বহুলাংশে কল্পনানির্ভর বিষয় দিয়ে আবর্তিত হওয়ায় রোমান্সে স্থান পায় সম্ভাব্য অনেক অঘটন বা প্রবাবল ইম্পসিবিলিটি। তেমনই এক অঘটন বলা যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে। কিন্তু অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে রোমান্টিকতার সম্পর্ক কী?
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বছরের পর বছর ধরে চলছে সংঘাত, যেখান থেকে কোনো দেশ হয়েছে দেউলিয়া, কেউ তলিয়ে গেছে রাজনৈতিক অস্থিরতায়। আবার চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বিশ্বে। কিন্তু এসবের মধ্যেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফুলেফেঁপে উঠেছে অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলো। এমনকি করোনা মহামারির মতো সংকটকালেও লোকসান তো দূরের কথা; এসব কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেক বিশ্লেষকের মতে, বিশ্বজুড়ে সশস্ত্র সব সংঘাতের নেপথ্যে রয়েছে বড় বড় অস্ত্র কোম্পানি।
প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দায় থাকলেও, বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের সামনে মানবিক বিপর্যয়ের তোয়াক্কা করে না অস্ত্র কোম্পানিগুলো। বরং নিজেদের অস্ত্র ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে যুদ্ধ বা যুদ্ধ পরিস্থিতি উসকে দেয়া তাদের কাছে পরিণত হয়েছে একরকম রোমান্টিসিজমে। বলা যায়, যুদ্ধের প্রেমে পড়েছেন তারা। উদ্দেশ্য একটাই–যত বেশি সংঘাত, তত বেশি ব্যবসা।
রাজনীতি কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রেও কি রোমান্টিসিজম প্রভাব ফেলতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে উদাহরণ হিসেবে টানা যায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রসঙ্গ।
একসময় ছিলেন কৌতুক অভিনেতা। সেখান থেকে জেলেনস্কি আজ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট, যিনি রাশিয়ার মতো একটি পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কমেডিয়ান হিসেবে অভিনয়ে হাতেখড়ি, এরপর তাকে দেখা গেছে একাধিক টেলিভিশন শোতে। ২০০৮ সালে ফিচার ফিল্ম ‘লাভ ইন দ্য বিগ সিটি’ এবং পরে এর সিক্যুয়েল ‘লাভ ইন দ্য বিগ সিটি ২’-তেও কাজ করেন জেলেনস্কি। এরপর কাজ করেছেন ‘অফিস রোমান্স’ ও ‘আওয়ার টাইম’-এর মতো চলচ্চিত্রে। কিন্তু এমন রোমান্টিক চরিত্রের একজন মানুষই আজ হয়ে ওঠেছেন রীতিমতো যুদ্ধবাজ। পশ্চিমাদের দেয়া অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে মোকাবিলা করে চলেছেন ক্রেমলিনকে। আর এসব অস্ত্র ও সরঞ্জাম আসছে মূলত অস্ত্র কোম্পানিগুলোর হাত ধরেই। ফলে গড়ে উঠেছে অস্ত্র ব্যবসার এক রোমান্টিক বলয়।
বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি
ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হয়েছে গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি এবং এখন পর্যন্ত এ সংঘাত বন্ধের কোনো সম্ভাবনা নেই। যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছে অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম চেয়ে আবেদন জানিয়ে আসছেন। সম্প্রতি, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে যুদ্ধ ট্যাংক সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই লক্ষ্য করা যায়, বিভিন্ন দেশ তাদের সামরিক বাজেট বাড়াচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয়ের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায়। আর এ ব্যয় বৃদ্ধির অর্থ হলো অস্ত্র কোম্পানি বা প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর আরও মুনাফা- বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরবরাহ চেইনের বাধাগুলো সহজ করে এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে চতুর্থ ত্রৈমাসিকে আরও বেশি অস্ত্র বিক্রির প্রস্তুতি নিয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলো। কারণ পেন্টাগন ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্যও ব্যয় বাড়িয়েছে।
লকহিড মার্টিন এবং রেথিয়ন টেকনোলজিস নামে দুটি মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা সম্প্রতি তাদের চতুর্থ-ত্রৈমাসিক আয়ের তথ্য জানিয়েছে। এর মধ্যে লকহিড মার্টিন ২০২২ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ১৯ বিলিয়ন ডলারের নিট বিক্রির কথা জানিয়েছে। ২০২১ সালের চতুর্থ-ত্রৈমাসিকে যা ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অন্যদিকে এ সময়ের মধ্যে শেয়ারের দাম বেড়েছে রেথিয়ন টেকনোলজিসেরও। আয় বেড়েছে এমন আরও বেশকিছু মার্কিন অস্ত্র কোম্পানির।
এদিকে ইউক্রেনকে সহায়তাকারী অনেক দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পাঠানো তাদের সামরিক সরঞ্জাম পুনরায় পূরণ করছে এবং তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর জন্যও কাজ করছে। ফলে অস্ত্র ব্যবসার গতিও সেই তালে বাড়ছে।
গত বছর ইউক্রেনকে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, হেলমেট, মেডিকেল কিট এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা জাপান ২০২৩ সালে তার প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রেকর্ড ৮৬৩ বিলিয়ন ডলার বাজেট উন্মোচন করে জাপান সরকার। সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা বলছে, ওই বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি টমাহকস এবং অন্যান্য দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যেগুলো চীন বা উত্তর কোরিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। জাপান সরকার নরওয়ে এবং লকহিড মার্টিন থেকে যুদ্ধবিমান থেকে উৎক্ষেপণের জন্য স্ট্যান্ডঅফ মিসাইলও কিনবে বলে জানা গেছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে, তার সরকার আগামী বছরগুলোতে সামরিক ব্যয় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বাড়াবে। গত ২০ জানুয়ারি এক ভাষণে তিনি বলেন, ২০২৪-২০৩০ সালের পরিকল্পিত বাজেট সামরিক বাহিনীকে ‘উচ্চ-তীব্র সংঘাতের শঙ্কার’ সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়ক হবে। এই সময়ের জন্য বাজেট দাঁড়াবে ৪৪৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯-২০২৫ সালের তুলনায় ৩২০ বিলিয়ন ডলার বেশি।
এদিকে ইউক্রেনকে লিওপার্ড-২ ট্যাংক সরবরাহের ঘোষণা দেয়া জার্মানি গত বছর তার প্রতিরক্ষা বাজেট অনুমোদন করেছে। ২০২৩ সালের জন্য জার্মানির মূল প্রতিরক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ হবে ৫৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের তুলনায় মাত্র ০.৬ শতাংশ কম।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে জার্মান সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং ইউরোপে তাদের ভূমিকা নিয়ে বার্লিনে তীব্র বিতর্ক চলছে। এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র তিন দিন পরই জার্মান চ্যান্সেলর দেশের প্রতিরক্ষা নীতির জন্য ‘যুগ পরিবর্তনের’ ঘোষণা দিয়েছিলেন।
যুদ্ধের লাভ ঘরে তুলছে কে?
সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং এই সত্যটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্র ছাড়া দিনের পর দিন রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সক্ষমতা ছিল না ইউক্রেনের। সেদিক বিবেচনায় বলা যায়, মার্কিন অস্ত্র শিল্পই এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বিজয়ী।
তবে সমালোচনার মুখে পড়েছে ওয়াশিংটনও। গত বছরের নভেম্বরে, ইউরোপীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে লাভবান হওয়ার অভিযোগ তোলেন। পলিটিকোর সঙ্গে আলাপকালে এমন এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘সত্যটি হলো, আপনি যদি গভীরভাবে দেখেন তবে এই যুদ্ধ (ইউক্রেনে) থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান দেশটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। কারণ যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংকটকে ব্যবহার করে তারা বেশি দামে বেশি গ্যাস বিক্রি করছে এবং আগের তুলনায় অস্ত্রও বেশি বিক্রি করছে।’