ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে এই মুহূর্তে বড় সংকটে বিশ্ব। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ সংকট আরও ঘনিভূত হয়েছে। গত এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগের কেন্দ্রে এই যুদ্ধ। তবে এর মধ্যে কোনো দিক থেকেই কম ছিল না যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ দুইটির মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতাই যেন চলতি একুশ শতকের ‘প্রধান চালিকাশক্তি’।
নানা ঘটন-অঘটনের মধ্যদিয়ে দ্রুত বদলাচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত যেসব সব ঘটনা উঠে আসছে প্রায়ই তার কেন্দ্রে জায়গা করে নিচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব। যেমন ‘গোয়েন্দা বেলুন’ ইস্যুতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই শিরোনাম হয়েছে দেশ দুটি।
সম্প্রতি একটি চীনা বেলুন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে। সেটিকে গুলি করে ভূপাতিত করে ওয়াশিংটন। ওমনি শুরু হয় তোলপাড়, উত্তেজনা। ওয়াশিংটনের দাবি, চীন সামরিক উদ্দেশে বিশ্বজুড়ে নজরদারি প্রকল্প চালিয়ে আসছে। এটা সেই প্রকল্পেরই অংশ। বেইজিং ওয়াশিংটনের এ দাবি নাকচ করে জানায়, বেলুনটি একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ যন্ত্র। ভূলক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছে।
রাশিয়াকে সহায়তার বিষয়ে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি
বেলুন ইস্যুতে উভয় পক্ষের মধ্যে টানাপোড়েন এখনও অব্যাহত রয়েছে। তবে ইউক্রেন সংঘাত সেই টানাপোড়েনের মাত্রা আরও বাড়াচ্ছে। যার শুরু চলতি সপ্তাহে রাশিয়াকে সহায়তার বিষয়ে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারির মধ্যদিয়ে।
মিউনিখে গ্লোবাল সিকিউরিটি কনফারেন্সের ফাঁকে গত শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকের পর গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্লিঙ্কেন বলেন, বেইজিং মস্কোকে অস্ত্র সরবরাহ করার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছে। এতে ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন। হুশিয়ারি দিয়ে তিনি আরও বলেন, চীন যদি ইউক্রেনে ‘রাশিয়ার আগ্রাসনে’ অস্ত্র সহায়তা প্রদান করে তাহলে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে।
চলতি সপ্তাহেই ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তি হচ্ছে। দেশটিতে রাশিয়া সামরিক অভিযানে পশ্চিমারা সমালোচনা করলেও চীন এখন পর্যন্ত নীরব রয়েছে। সেই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইউক্রেনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, রাশিয়ায় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই গত সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেন সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটা তার প্রথম কিয়েভ সফর। এ সফরকালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে বাইডেনের এ সফরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সবশেষ পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ইস্যুতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে চীন। বাইডেনের সফরের পরদিন মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে ‘আগুনে ঘি ঢালছে’। ইউক্রেন কেন্দ্রিক সংঘাত যেকোনো মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
কিন গ্যাং বলেন, ‘আমরা কয়েকটি দেশের প্রতি আহ্বান জানাই, আগুনে ঘি ঢালা বন্ধ করুন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাদের অবশ্যই আজ ইউক্রেনকে উসকানি দেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং আগামীকাল তাইওয়ানের ক্ষেত্রের একই পদক্ষেপ নিতে হবে।’ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উচ্চারণ করেননি। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশেই যে এ কথা বলেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
চীন শুধু উদ্বেগই নয়, বাইডেনের সফরের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে নিজেদের শীর্ষ কূটনীতিককে রাশিয়া সফরে পাঠিয়েছে। বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) মস্কোয় পৌঁছান চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ওয়াং ই। এদিন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন ওয়াং। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ক্রেমলিনে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের একটি বৈঠক হয়েছে। তবে সে বৈঠকের বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন মতে, ল্যাভরভের সঙ্গে বৈঠকে ওয়াং বলেছেন, রাশিয়া ও চীন একটি ‘মাল্টি পোলার’ বা বহু মেরুর বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর, যেখানে কোনো দেশের একক আধিপত্য থাকবে না। চীনা কূটনীতিক আরও বলেন, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চেষ্টায় দুই দেশের মধ্যে একটি ‘অত্যন্ত শক্তিশালী’ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। রাশিয়া ও চীন এমন একটি বহু-মেরুর বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর যেখানে কোনো একটি দেশের আধিপত্য থাকবে না।
রাশিয়া সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শি জিনপিং
মস্কো থেকে এখনও ফেরেননি চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং। এরইমধ্যে খবর এসেছে রাশিয়া সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। খবরে বলা হয়েছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগামী মাসে রাশিয়া যাবেন তিনি।
চীনা প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য রাশিয়া সফরের পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এ খবর জানিয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র যাতে ব্যবহার করা না হয় সে বিষয়েও পুতিনের সঙ্গে কথা বলবেন শি জিনপিং।
ইউক্রেনের হুঁশিয়ারি
বাইডেনের কিয়েভ সফরের পর ইউক্রেনের জোর যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। যার দাপটে এবার শক্তিশালী চীনকেও অকপটে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে দেশটি। সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি চীনকে সতর্ক করে বলেন, রাশিয়াকে সমর্থন করলেই হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মান দৈনিক পত্রিকা ডাই ওয়েল্টকে জেলেনস্কি জানান, যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল চীন রাশিয়াকে সমর্থন করছে না। বলেন, আমি চাই চীন আমাদের পাশে থাকুক। তবে এই মুহূর্তে আমি মনে করি না এটি সম্ভব। চীন যদি রাশিয়ার সঙ্গে একত্রিত হয়, তাহলে বিশ্বযুদ্ধ হবে। আমি মনে করি যে চীনও সেই ব্যাপারে অবগত আছে।