প্রবাদ আছে, যুদ্ধের প্রথম বলি ‘সত্য’; কিন্তু তারচেয়েও বড় সত্য, যুদ্ধের প্রথম বলি মানুষ। সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যেকার যুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ভূমিকম্পের পর এ সত্য আরও প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে সেই অর্থে কোনো আন্তর্জাতিক সহয়তা নেই। ত্রাণ, তাঁবু কিংবা খাবার কিছুই নেই।
ভূমিকম্পে তুরস্কের দক্ষিণ ও সিরিয়ার উত্তরাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরল সীমকরণ বলে, আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহায়তাও দুই দেশের জন্য সমান হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সব ত্রাণ, ব্যাপক উদ্ধার সরঞ্জাম, বিপুল সংখ্যক উদ্ধারকর্মী এবং আর্থিক সহায়তা – সবই এসেছে তুরস্কের জন্য। অথচ সীমান্তের গা ঘেঁষে থাকা সিরীয় জীর্ণশীর্ণ শরণার্থী শিবির থেকে এসব দেখা গেলেও তাদের কাছে পৌঁছায় না কোনোকিছুই। তেমন সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না।
তাহলে কি পৃথিবী সিরিয়াকে ভুলে গেছে! মানুষের মন থেকে কি সিরীয়রা মুছে গেছে!
সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের বাসানিয়া গ্রাম তুরস্কের আন্তাকিয়া শহর সংলগ্ন। নতুন গড়ে ওঠা বাসানিয়া গ্রামটিতে সদ্যই শতাধিক নতুন সুউচ্চ দালান গড়ে তোলা হয়েছিল, যার অধিকাংশই বিধ্বস্ত হয়েছে। আন্তাকিয়ায় যখন কয়েকশ যন্ত্র আটকেপড়া মানুষদের উদ্ধার কাজ করছে, যখন এক্সক্যাভেটরগুলোর গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠছে চারপাশ, তখন বাসানিয়ার পরিবেশ অনেকটাই শান্ত। কোথাও কোথাও থেকে হঠাৎ বিলাপ কিংবা ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ ভেসে আসছে। এর বাইরে আর তেমন কোনো শব্দ নেই। মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া গ্রামটিতে নেই ব্যাপক উদ্ধার তৎপরতা। বিদ্রোহীরা তাদের হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে যা পেরেছে উদ্ধার করেছে, করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘ কেবল ১৪ ট্রাক ত্রাণ পাঠিয়েই দায় সেরেছে।
বাসানিয়া গ্রামেরই বাসিন্দা আবু আলা। ভূমিকম্পে বাড়ি তো গেছেই, সঙ্গে গেছে তার দুই সন্তানের প্রাণ। ধ্বংসস্তূপের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এখানেই আমার শয়নকক্ষ ছিল, এটিই তো আমার বাড়ি ছিল। এখানেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম।’ আবু আলার কথা থেকে জানা গেল, তার ১৫ বছর বয়সী মেয়ে ওয়ালা ব্যালকনির পাশের কামরায় শুয়ে ছিল। একটি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে কোনোমতে ওয়ালার মরদেহ বের করা হয়।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। আবু আলা এবং তার সন্তানহারা স্ত্রী জলপাই গাছের নিচে শতছিন্ন একটি ত্রিপলের ওপর কুকড়ে বসে ছিলেন। তারা জানালেন, এখানকার বিদ্রোহীরা যারা ব্রিটিশ সরকারে কাছ থেকে খুব সামান্যই অর্থ পাচ্ছে- তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রচেষ্টায় আবু আলার কন্যার মরদেহ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টা পর ১৩ বছর বয়সী ছেলের মরদেহও উদ্ধার করা হয়। ছেলের মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টি বলতে গিয়ে বারবার আবু আলার গলা ধরে আসছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবু আলা বলেন, ‘ভূমিকম্পের পরপরেই শুরু করে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা খনন কাজ চালিয়ে যাই। অবশেষে তার মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।’ উদ্ধারকারীদের প্রশংসা করে আবু আলা বলেন, ‘আমার ছেলেকে উদ্ধার করতে গিয়ে তারা দীর্ঘ নরক যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে গেছেন। খোদা তাদের প্রতি রহম করুক।’
আবু আলা খুবই ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ। সব হারিয়ে বিষণ্ণ-বিপর্যস্ত মানুষটি বারবার বলছিলেন, আমার এখন কী হবে? কথা শেষে বিবিসির প্রতিবেদক কোয়ন্টিস সামারভিল এবং তার সঙ্গীরা যখন ফিরছিলেন, তখন আবু আলা তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাদের কাছে ছোট একটি তাঁবু হবে কিনা। কিন্তু সামরভিল তাকে কিছুই দিতে পারেননি।
স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী হোয়াইট হেলমেটসের উদ্ধারকারী দলের সদস্য ইসমাইল আল-আব্দুল্লাহ জানালেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাউকে জীবিত পাওয়ার আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখানে যারা বিনা উদ্ধার প্রচেষ্টার কারণে মারা গেল তাদের রক্ত লেগে আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে।’
ইসমাইল আল-আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ভূমিকম্পের ১২০ ঘণ্টারও বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ায় জীবিত লোক উদ্ধারে আশা ছেড়ে দিয়েছি, সন্ধানও বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা আমাদের জনগণকে বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি; কিন্তু পারিনি। কেউ আমাদের কথা শোনেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ ও জরুরি সাহায্যের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। কেউ সাড়া দেয়নি। সবাই কেবল বলছে, “আমরা আপনার সঙ্গে আছি”, আর কিছু নয়। আমরা বলেছিলাম, আমাদের সরঞ্জাম দরকার; কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি।’
সিরিয়ার জনগণকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বহুবার পরিত্যাগ করেছে। তারা ই অবহেলায় অভ্যস্তও হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারপরও ভয়াবহ এ বিপর্যয়ের সময় আরও সাহায্য আসছে না বলে তাদের ক্ষোভ রয়েছে।
হারেম শহরের বাসিন্দা ফাদেল আল-ঘাদাব তার খালা এবং খালাতো ভাইকে হারিয়েছেন। ফাদেল জাতিসংঘের ১৪ ট্রাক ত্রাণ পাঠানোকে প্রহসন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি কীভাবে সম্ভব যে, জাতিসংঘ মাত্র ১৪ ট্রাক সাহায্য পাঠিয়েছে? অথচ সব হারিয়েও আমরা এখানে এখনো কিছু পাইনি। এখানকার হাজারো মানুষ খোলা রাস্তায় বসবাস করছে।’
জাতিসংঘের ১৪ ট্রাক ছাড়াও আরও কিছু সাহায্য সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে। তবে তা খুব বেশি নয় এবং অনেক দেরি হয়ে গেছে। হারেমে আন্তর্জাতিক উদ্ধারকারী দলের অনুপস্থিতিতে শিশুরাই ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করছে। এক ব্যক্তি তার দুই ছেলে মিলে একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ আলাদা করে যত্ন সহকারে একটি কম্বলে পশুর খাদ্য উদ্ধার করছেন। এমন দৃশ্য প্রায় সর্বত্রই দেখা গেল। জীবন বাঁচানোর তাগিদে খালি হাতেই লড়ছে ভূমিকম্পকবলিত সিরীয়রা। তাদের জীবন সস্তা নয়, তবে এটি এখন আরও অনেক বেশি অনিশ্চিত। আরও দুঃখের বিষয় হলো, পৃথিবী আক্ষরিক অর্থেই আবু আলা, ফাদেল এবং সিরিয়াকে ভুলে গেছে, পরিত্যাগ করেছে। ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশের ভাষায়, ‘পৃথিবী আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে।’