Homeজেলালক্ষ্মীপুর -ভোলা ফেরী রুটে নাব্যতা সংকটে ভোগান্তি, ড্রেজার চললেও মিলছেনা সুফল

লক্ষ্মীপুর -ভোলা ফেরী রুটে নাব্যতা সংকটে ভোগান্তি, ড্রেজার চললেও মিলছেনা সুফল

মু.ওয়াহিদুর রহমান মুরাদ,করেসপন্ডেন্ট||
 
লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীহাট ফেরিঘাটের এক কিলোমিটার দূরে রহমতখালী চ্যানেল। সম্প্রতি এই চ্যানেলে জেগে উঠেছে বিশাল এক ডুবোচর। এই নৌ-রুটের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকটি নতুন ডুবোচর জেগে উঠেছে। এসব ডুবোচরের আশপাশের এলাকায় ভাটার সময় থাকে কোমর সমান পানি। এতে করে প্রতিদিন চার থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌযান ডুবোচরে আটকে থাকে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা। জোয়ারের সময় নদীতে পানি কিছুটা বাড়ে। তখন ফেরি ও লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক হয়।
 
ফেরিঘাটের সমস্যা নিয়ে কথা হয় ভোলার দিঘলদীর লুৎফর রহমান (৪৭) এর সঙ্গে। তিনি চাকরি করেন চট্টগ্রামে। তার এক স্বজন মৃত্যুবরণ করেছেন শনিবার। রোববার (৫ জানুয়ারি) সকালে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ নিয়ে আসেন লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরী হাটের ফেরিঘাটে। দুই ঘণ্টা পার হলেও ফেরির দেখা নেই।
 
আক্ষেপ প্রকাশ করে লুৎফর রহমান বলেন, ক্যামেরার সামনে কথা বলে কি হবে? আমাদের কষ্টের কথাগুলো মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে আসলেও কোনো প্রতিকার দেখছি না। এ রুটে প্রায় আমাদে দুর্ভোগে পড়তে হয়। এ ঘাটে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। টয়লেট নেই। যাত্রীদের বসার কোনো স্থান নেই। নদীর নাব্যতার সংকটের কারণে শুকানো মৌসুমে ফেরি আটকা পড়ে।
 
শওয়ান নামে এক যুবক বলেন, আমার বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। চাকরি করি বরিশালে। দুদিন আগে বরিশাল থেকে ফেনীতে যাই। আজ ভোররাতে ফেরিঘাটে আসি। ১০টার মধ্যে বরিশাল অফিসে থাকতে হবে। এখন প্রায় ৯টা ১৫ বাজে এখনও ফেরির দেখা নেই। এক জায়গা বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেব, সেই সুযোগ ও নেই। চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় এ ফেরিঘাটে। কাউন্টারও বন্ধ। সংশ্লিষ্ট কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
 
রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল পৌনে ৮টার দিকে মজুচৌধুরী হাট ফেরিঘাটে গিয়ে ভোলা ও বরিশালগামী কিছু সংখ্যক যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীত মৌসুমে কুয়াশা ও নাব্যতার সংকটের কারণে লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌ-রুটের ফেরি ও লঞ্চ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
 
ফলে শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক ভোলার ইলিশা ঘাটে যাওয়ার জন্য লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরী হাটের ফেরিঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় বসে আছে। অপর পারেও একই অবস্থা। গত ৩ মাস ধরে মানুষের এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কনকচাঁপা ফেরি ঘাটে আসে।
 
বিআইডব্লিউটিসির কর্তকর্তারা বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌ-রুট দিয়ে যাতায়াত করে। ২০০৬ সালের এপ্রিলে তিনটি ফেরি নিয়ে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মজুচৌধুরীহাট ফেরিঘাটটি চালু করে সরকার। এখন কলমিলতা, কনকচাঁপা, কিষানী ও কাবেরীসহ পাঁচটি ফেরি চলাচল করছে। এ ছাড়া প্রতিদিন এই ঘাট থেকে কয়েক হাজার যাত্রী নিয়ে ৮ থেকে ১০টি লঞ্চ ভোলার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
 
ফেরি ও লঞ্চের চালকেরা বলেন, চ্যানেলের মুখ সরু হয়ে পড়ায় ফেরি চলাচল বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ফগ লাইট না থাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে সামান্য কুয়াশায়ও মাঝনদীতে ফেরি নোঙর করাতে বাধ্য হন তারা। ফলে দুই পারে পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে আটকে থাকতে হয় দিনের পর দিন।
 
ভোলাগামী পণ্যবাহী ট্রাকের চালক আজিম বলেন, গত ২ থেকে ৩ মাস ধরে লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌ-রুটে নাব্যসংকটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয় এই নৌ-রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের। সঠিক সময়ে গন্তব্যে ফেরি ও লঞ্চ না পৌঁছায় দুই পারে দিনের পর দিন আটকে থাকতে হয়। এ কারণে ট্রাকের কাঁচামাল ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
 
ফেরিঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় থাকা রডবোঝাই ট্রাকের চালক হানিফ মিয়া বলেন, গত বুধবার রাতে ঘাটে এসেছি। এখন পর্যন্ত সিরিয়াল পাইনি। ভোলা যাব, কিন্তু পানি কম থাকায় ডুবোচরের কারণে ঠিকমতো ফেরি চলাচল করতে পারছে না। এতে করে চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছি। পাশাপাশি টয়লেট ও খাবারের হোটেলের সংকটও রয়েছে। এইভাবে আমার মতো আরও অনেক চালক পাঁচ থেকে সাত দিন ধরে পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে ঘাটে বসে আছে।
 
ফেরী কনকচাঁপার (চালক) মাস্টার অফিসার মো. মহসিন খাঁন  বলেন, আমাদের এ নৌ রুটে ৫টি ফেরি চলাচল করে। বর্ষাকালে নদীতে ফেরি আসা-যাওয়া করতে তেমন সমস্যা হয় না। ২ আড়াই ঘন্টার মধ্যে আমরা লক্ষ্মীপুর থেকে ভোলা যেতে পারি। আর এখন শুকনো মৌসুম নদীতে পানি কম। এজন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পারাপার হতে পারি না। এতে আমাদে প্রায় সাড়ে ৩ ঘন্টা থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে ঘাটে ফিরতে। যার ফলে যাত্রীদের যেমন দুর্ভোগে পড়তে হয়, তেমনি আমাদেও অনেক সময় নষ্ট হয়। নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে এ প্রধান সমস্যা। আমরা দেখি বিভিন্ন পয়েন্ট নদী খনন কাজ চলে। এখান দিয়ে করলে আবার, অন্যস্থানে একই চর জেগে উঠে।
 
মজুচৌধুরী হাট ফেরীঘাটের (বিআইডাব্লিউটিসি) দায়িত্বপ্রাপ্ত কামরুল রশিদ ক্যামেরার সামনে কোনো কিছুই বলতে চাননি। যাত্রীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।
 
জেলা বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সঠিক সময়ে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিবছরই নামমাত্র ড্রেজিং করা হয়। বাস্তবে কোনো কাজ হচ্ছে না। দ্রুত জেগে ওঠা চরগুলো ড্রেজিং করে নৌরুটে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
 
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মজুচৌধুরীহাট ফেরিঘাটের (বিআইডাব্লিউটিসি) ব্যবস্থাপক মো. কাউছার বলেন, বর্তমানে পাঁচটি ফেরি চলাচল করছে। ঘন কুয়াশা ও নদীতে ডুবোচর জেগে ওঠায় ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে জোয়ার-ভাটার দিকে তাকিয়েই ফেরি ও লঞ্চ ছাড়তে হয়। এ ছাড়া প্রতিবছরই ড্রেজিং করা হয়। তবে নামমাত্র। এসব ড্রেজিং দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
 
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, ইতোমধ্যে আমরা নৌ-মন্ত্রণালয়ের কাগজপত্র নিয়ে সংশ্লিষ্ট সচিব ও ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করছি। খুব শিগগিরই আধুনিক নৌ-বন্দর হবে। আর নদীর নাব্যতার সংকট নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিআইডাব্লিউটিসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ফেরি ঘাটের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।

সর্বশেষ খবর