ইউক্রেন যুদ্ধের ১০ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণভাবে যথেষ্ট চাপ সহ্য করতে হয়েছে রাশিয়াকে। ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা এবং ব্যাপক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরও রুশরা এমনভাবে চলছে যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। দেশটির ধনকুবের বা এলিট শ্রেণি পুতিনের প্রতি সমর্থন জানানো ছাড়া কিছু করছেন না। তারা এমন ভাব করছেন যেন আগেও কিছু ঘটেনি, আগামীকালও কিছু ঘটবে না।
অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না। ২০২৩ সাল রাশিয়ার জন্য নাটকীয় বছর হতে যাচ্ছে। রাশিয়ার বর্তমান নেতৃত্ব টিকে থাকবে কিনা, তা নির্ধারিত হতে পারে এ বছরই। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে তিনটি অভ্যন্তরীণ প্রশ্নের ওপর, যা দেশটির বর্তমান তো বটেই আগামী কয়েক দশকেরও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে।
প্রথমত, ২০২৩ সালেই পুতিনকে নির্ধারণ করতে হবে যে, তিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, নাকি নিজের উত্তরসূরি ঘোষণা করবেন। দেশটির ২০২০ সালের সংশোধিত সংবিধান অনুসারে, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবেন পুতিন। তারপরও নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পুতিনের হাতে এখনো পর্যাপ্ত সময় রয়েছে। রাশিয়ায় পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের মার্চে। ফলে পুতিন চাইলে চলতি বছরের শেষ দিকেও তার সিদ্ধান্ত জানাতে পারবেন।
তবে এ বিষয়ে পুতিনের পরিকল্পনা কী, সে বিষয়ে কেউ অবগত নন। এমনকি তার প্রিয়ভাজন এলিটরাও রয়েছেন অন্ধকারে। ২০২০ সালের গ্রীষ্মে পুতিন তার ক্ষমতার মেয়াদ আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য সংবিধান সংশোধন করেন। সে সময় তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে থাকা দেশটির এলিট শ্রেণির দ্বন্দ্বকে সংবিধান সংশোধনের কারণ উল্লেখ করে সেটিকে ন্যায্যতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের কাজ করতে হবে, কে কার উত্তরসূরি হবে সে বিষয় ভেবে সময়ক্ষেপণ করা চলবে না।’
সংবিধান সংশোধনের পর দেশটির প্রশাসন ও এলিট শ্রেণি নিশ্চিতভাবেই অনুমান করে নেয়, পুতিনের ইচ্ছা অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতা ধরে রাখা। তবে বাস্তবতা হলো, তার সেদিনের হিসাব বদলে গেছে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এ যুদ্ধে কোনো কিছুই আর পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটছে না।
অনেকের বিশ্বাস, ইউক্রেন যুদ্ধ যেসব গভীর সম্যসা ও হুমকি হাজির করেছে, তা পুতিনের জন্য শাপে বরও হতে পারে। এসব সমস্যাই পুতিনের ২০২৪ সালের পরও ক্ষমতা ধরে রাখা নিশ্চিত করবে। পুতিন একাধিকবার বলেছেন, কঠিন সময়ে যারা রাজনীতির মাঠ ছেড়ে যায়, তাদের প্রতি তার প্রবল ঘৃণা রয়েছে। ফলে, এ দুঃসময়ে পুতিন পালিয়ে যাবেন এমনটা হবার নয়।
আবার অনেকে মনে করেন, এ যুদ্ধ কেবল পুতিনের ক্ষমতা ত্যাগের পথ তৈরি করেছে। তিনি হয়তো সংকট সমাধানের অংশ হিসেবে সেটি করবেনও। পুতিন যদি সত্যিই এমনটা করেন, তবে তা রাশিয়া সম্প্রতি যেসব নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছে, তা থেকে উদ্ধারে বেশ সহায়ক হবে।
শঙ্কার বিষয় হলো, এ দুই পক্ষের ভাবনা একান্তই তাদের নিজেদের। কারণ, পুতিনের আশপাশের কেউই হয়তো জানেন না তার মনে কী চলছে! পুতিন প্রায় সব বিষয়েই শেষ মুহূর্তে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ায় সিদ্ধহস্ত। একই সঙ্গে তিনি পরিস্থিতির দাবি বিবেচনায় জনপ্রত্যাশার বিরুদ্ধেও সিদ্ধান্ত নেন। সেক্ষেত্রে ২০২৪ সালে রাশিয়ায় কী হতে যাচ্ছে এবং ২০২৩ সালে পুতিন কী করবেন, তা দেশটির এলিট শ্রেণির মাথাব্যথার কারণ হয়েই দেখা দেবে।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো রাশিয়ার দুই শ্রেণির এলিটদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে। এক পক্ষ যুদ্ধের পক্ষে ওকালতকারী গোষ্ঠী; অন্যদিকে রয়েছে, যারা যুদ্ধ না করার পক্ষপাতী। ইউক্রেনের খারকিভ থেকে রুশ সেনাদের পশ্চাদপসারণের পর এ বিভেদ আরও স্পষ্ট হয়। ক্রিমিয়া সেতুতে বিস্ফোরণ সেই বিভেদের আগুনে আরও উসকানি দেয়। একই সঙ্গে রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনের চার অঞ্চলকে গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার বিষয়টিও এ বিভেদের আগুনে ঘি ঢেলেছে।
রাশিয়ায় যারা বাস্তববাদী – যে তালিকায় বিশেষজ্ঞ, মধ্যবর্তী শ্রেণির কর্মকর্তা এবং সামরিক কর্মকর্তাও রয়েছেন, তারা মনে করেন, এ যুদ্ধ শেষ হওয়া দরকার। এ বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করা প্রয়োজন। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে; কিন্তু আগামী দিনে যেন দেশের বর্তমান সম্পদ ও সক্ষমতা নিয়ে আরও বাস্তববাদী পদ্ধতিতে টিকে থাকা যায়।
এ শ্রেণির বিপরীতে আরেকদল উগ্রপন্থি রয়েছেন, যাদের বাজপাখি বলে আখ্যায়িত করা হয়। তারা চান, রাশিয়া ইউক্রেনে নিজের সামরিক সক্ষমতার পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটাক এবং দেশটির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোকে পুনর্গঠন করুক। পরের দলটি বর্তমান সরকারকে স্থবির বলে মনে করে।
আপাতদৃষ্টিতে তারা পুতিনপন্থি বলে পরিচিত হলেও, তারা চায় বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারকে সরিয়ে দিতে।
রাশিয়ায় এ দুদলের মধ্যকার রাজনৈতিক লড়াই ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকবে। তবে এ দুদলের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে মূলত ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। কারণ, যুদ্ধে রাশিয়া যত বেশি দুর্বল হতে থাকবে বাস্তববাদীরা তত বেশি উজ্জীবিত হবে। বিপরীতে, যুদ্ধে রাশিয়া ভালো করলে তা বাজপাখিদের প্রাধান্য কায়েম করবে রাজনীতিতে। তবে পুতিন ও ক্রেমলিনের অধিবাসীরা হয়তো এসব বিষয় তামশাভরে দেখবেন না। তারাও নিশ্চয়ই বিরুদ্ধমত দমনের নতুন কোনো পন্থা খুঁজে বের করে ফেলবেন।
যুদ্ধের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বাজপাখি তথা উগ্রপন্থিরা রাশিয়ার শীর্ষ সামরিক ও রাজনীতিবিদদের লক্ষ্য করে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেবে। মস্কো যুদ্ধে যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলে সেগুলো অর্জন যে অসম্ভব, তা স্বীকার করতে জোর করে যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক ফলাফল নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে থাকবে বাস্তববাদীরা।
রাশিয়ার বাস্তববাদী এবং উগ্রপন্থি রাজনৈতিক দলের মধ্যকার এ টানাপোড়েন পুতিনকে বহুমুখী চাপে ফেলবে। তাকে বেছে নিতে হবে তিনি ইউক্রেনে আক্রমণ চালাতেই থাকবেন নাকি সৈন্য সরিয়ে আনবেন। তবে তার আগে পুতিনকে যা করতে হবে তা হলো, তার সম্মান বাঁচানোর জন্য ইউক্রেনকে হারানো কিংবা কিয়েভ বা পশ্চিমা বিশ্বকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনা।
তৃতীয় যে বিষয়টি রাশিয়া ২০২৩ সালে মোকাবিলা করবে তা হলো দেশটির প্রাশাসনিক পরিবর্তন। শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে কারা বসবেন তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। যদিও এটি অনুমান করা খুব একটা কঠিন নয় যে, কারা শীর্ষ পদগুলোতে বসতে যাচ্ছেন। তারপরও অনেক যদি, কিন্ত থেকে যায়।
প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে রদবদল প্রায় নিশ্চিতই বলা যায়। বিশেষ করে কার্যকারিতা এবং গতিশীলতার খাতিরেই এ রদবদল জরুরি। তবে নানা কারণেই টেকনোক্র্যাটদের প্রশাসনের শীর্ষ পদে আনার প্রবণতা বাড়তে পারে পুতিনের। মন্ত্রিসভায়ও যদি দু-চারজন টেকনোক্র্যাট ঢুকে পড়েন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যুদ্ধ এবং দীর্ঘ সময়ের চাকরি জীবনের কারণে অনেকেই ক্লান্ত। এ অবস্থায় পুতিন নতুন আইডিয়ার জন্য টেকনোক্র্যাটদের দ্বারস্থ হতে পারেন। আরেকটি কারণ হলো রাশিয়ার নির্বাচনী ইতিহাস। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রশাসনে রদবদল হয়নি এমনটা কখনো ঘটেনি।
এর বাইরেও প্রশাসনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা এবং স্তরের মধ্যে ব্যক্তিগত বৈরিতাও রদবদলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ। যেমন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভকে সশস্ত্র বাহিনীর অনেকেই দুর্নীতিবাজ বলে মনে করেন। গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবিকে গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য দায়ী করছেন অনেকে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভও পায়ের তলায় মাটি হারিয়ে ফেলেছেন। মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিনকে অরাজনৈতিক বলেই বিবেচনা করছেন পুতিনের ঘনিষ্ঠজনরা। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এলভিরা নাবিউলিনাও যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন এমন সন্দেহ রয়েছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকেই পুতিনের রাডারে সন্দেহভাজন বলে ধরা দিয়েছেন। এর বাইরেও তারা একে অপরের প্রতি বিরাগভাজন এবং এ ব্যক্তিগত বৈরিতা পুতিনকে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদলের ন্যায্যতা দেবে। তবে তার চরিত্রের রক্ষণশীলতা এবং ভয় তাকে হয়তো ততটা আগ্রাসী হয়ে উঠতে দেবে না রদবদলের ক্ষেত্রে। বরং ভারসাম্য বজায় রাখার দিকেই বেশি নজর দিতে পারেন পুতিন।
তবে এসব বিষয়ই আবার নির্ধারিত হবে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। রাশিয়া যদি আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ আক্রমণ ত্বরান্বিত করে তবে তাদের প্রবল বাধার মুখোমুখি হতে হবে। আবার রাশিয়া যদি বর্তমানের মতো ইউক্রেনের অবকাঠামো লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে, সেক্ষেত্রে ইউক্রেন রাশিয়ার মাটিতেও হামলা বাড়াতে পারে।
সবকিছুই গোপনে করা এবং নিজেকে অন্যের কাছে সহজবোধ্য না করার পুতিনের যে প্রবণতা, তা চলমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। তবে ভিন্নমত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দমন-পীড়নও বাড়বে। সকল ভিন্নমতাবলম্বীকে অপরাধী করা হবে, রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের উপাদানগুলো জোর করে চাপিয়ে দেয়া হবে এবং ভিন্নমতের লোকদের আরও দীর্ঘমেয়াদে কারাদণ্ডের জন্য নতুন অজুহাত সামনে হাজির করা হবে।
সব মিলিয়ে, ২০২৩ সালে ইউক্রেনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া যুদ্ধই রাশিয়াকে ভেতর থেকে অনেকটা বদলে দেবে এবং পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশটির নেতৃত্বের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। ফলে চলতি বছর রাশিয়ার রাজনীতি তো বটেই, ইউক্রেন যুদ্ধেরও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে।
(মার্কিন থিংকট্যাকং কার্নেগি এনডাউমেন্টে প্রকাশিত তাতিয়ানা স্তেনোভায়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)