ইউক্রেনে একের পর এক ড্রোন হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। আর এতে ব্যবহার করা হচ্ছে ইরানি ড্রোন। এতে ক্ষুব্ধ ওয়াশিংটন। এ অবস্থায় ইরানের ড্রোন উৎপাদন বন্ধে উঠে পড়ে লেগেছে বাইডেন প্রশাসন। নতুন করে নিষেধাজ্ঞার চিন্তাভাবনাও করছে হোয়াইট হাউস।
ইরানি ড্রোনে যুক্তরাষ্ট্রের যন্ত্রাংশ
ইউক্রেনে ভূপাতিত করা ইরানের ড্রোনে এক ডজনেরও বেশি মার্কিন ও পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের তৈরি যন্ত্রাংশ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন ইউক্রেনের গোয়েন্দারা। গেল বছরের শেষ দিকে এ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনকে ইউক্রেনের গোয়েন্দারা অবহিত করেছেন বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
এ নিয়ে হোয়াইট হাউস বেশ উদ্বিগ্ন বলেও জানা গেছে। ইউক্রেনে প্রতিমুহূর্তে শত শত ইরানি ড্রোন পাঠাচ্ছে রাশিয়া। এ অবস্থায় ইরানের ড্রোন উৎপাদন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন এবং পশ্চিমাদের তৈরি প্রযুক্তি বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর এবং জিপিএস মডিউলের মতো ছোট সরঞ্জাম থেকে শুরু করে ইঞ্জিনের মতো বড় অংশে কীভাবে ইরান তার ড্রোনে ব্যবহার করেছে, তা তদন্তে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে বাইডেন প্রশাসন।
সেই টাস্কফোর্সের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে ভূপাতিত করা ইরানের তৈরি শাহেদ-১৩৬ ড্রোন থেকে ৫২টি উপাদান বের করা হয়েছে। যার মধ্যে ৪০টি উপাদানই ১৩টি ভিন্ন মার্কিন কোম্পানির তৈরি। বাকি ১২টি উপাদান কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান এবং চীনের কোম্পানিগুলো তৈরি করে।
ইরানের ড্রোন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?
এ সমস্যা সমাধান করার মতো বিকল্প খুবই কম বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইরান যেন উন্নত প্রযুক্তি সামগ্রী না পায় সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ধরে কঠোর রফতানি নিয়ন্ত্রণ বিধিনিষেধ এবং বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মার্কিন কর্মকর্তারা সেই নিষেধাজ্ঞা আরও সম্প্রসারিত করার দিকে জোর দিচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান এসব উপাদান রফতানি করে তাদের নিজস্ব সরবরাহ চেইন আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ ও যাচাই বাছাই করার তাগিদ দিয়েছেন।
তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তৃতীয়পক্ষের পরিবেশকদের চিহ্নিতকরণের ওপর। অর্থাৎ যারা এই পণ্যগুলো ইরানের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়েন ওয়াটসন এক বিবৃতিতে সিএনএনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা, রফতানি নিয়ন্ত্রণ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে ইরানের ড্রোন উৎপাদন বন্ধে কী কী করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করছে। ড্রোনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি যেন ইরান আর না পায় সেজন্যও রফতানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
তবে ড্রোনের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আইন লঙ্ঘন করছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপরও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আরও কঠোরভাবে রফতানি প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে ড্রোনের উপাদানগুলো শেষ পর্যন্ত কাদের হাতে যাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রায়শই নির্মাতাদের পক্ষে খুব কঠিন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
যেভাবে যন্ত্রাংশ পাচ্ছে ইরান
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সক্রিয় নয় এমন শেল প্রতিষ্ঠান বানিয়ে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে সামরিক সরঞ্জাম কেনা রাশিয়া ও ইরানের জন্য খুব কঠিন কিছু না। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্মোচন করতে করতে বছরের বেশি সময় লেগে যায়। মাইক্রো ইলেক্ট্রনিক্স শিল্প তৃতীয় পক্ষের ডিস্ট্রিবিউটর এবং রিসেলারদের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে, যেগুলো ট্র্যাক করা কঠিন।
ইরান এবং রাশিয়ার ড্রোনে যে মাইক্রোচিপ ও অন্যান্য ছোট ডিভাইস ব্যবহার করা হয় তা অনেক সস্তা এবং সহজলভ্য। তাই খুব সহজে ইরান ও রাশিয়া এগুলো ব্যবহার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা হীরার উদাহরণ দেন। তারা বলছেন, হীরা দেখতে অনেক ছোট এবং হালকা। কিন্তু দামের দিক দিয়ে অনেক মূল্যবান। কম্পিউটার চিপের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য।
কেন ইরানের ড্রোন উৎপাদন বন্ধ জরুরি?
পশ্চিমাদের জন্য ইরানের ড্রোন উৎপাদন বন্ধ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে কারণ, রাশিয়া নিরলসভাবে ইউক্রেনজুড়ে ইরানি ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বেসামরিক এলাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে মস্কো।
মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, ইরানের সহায়তায় ড্রোন উৎপাদনের জন্য নিজস্ব কারখানা স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি করেছেন, ইউক্রেনের সেনারা মাত্র দুই দিনে ৮০টিরও বেশি ইরানি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। জেলেনস্কি আরও বলেন, ইরানের শাহেদ ড্রোন দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণের পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। আর এমন গোয়েন্দা তথ্য তাদের কাছে আগে থেকেই ছিল। ইউক্রেনের জনগণ, আকাশ প্রতিরক্ষা এবং বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে ইরানি ড্রোন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ড্রোনের ৮২ ভাগ উপাদান যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের বানানো। কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চের ডেপুটি ডিরেক্টর অব অপারেশনস ড্যামিয়েন স্প্লিটার্স সিএনএনকে বলেন, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা কেবল তখনই কার্যকর হবে যখন তারা ড্রোনে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশগুলোকে শনাক্ত করতে পারবে। এছাড়া কীভাবে এই যন্ত্রাংশগুলোকে তাদের হাতে যাচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করার তাগিদ দেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে চায়, তবে তাদের আরও সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে। সেইসঙ্গে পণ্যের বিক্রেতা এবং পুনঃবিক্রেতাদের ট্র্যাক করার জন্য আরও বেশি লোকবল নিয়োগ করতে হবে। তাদের মতে, শিল্প নিরাপত্তা ব্যুরোর মতো এজেন্সিগুলোতে আরও বেশি বিনিয়োগ করার কথা কেউই ভাবেনি।