চুয়াডাঙ্গা জেলায় বেশ কয়েকদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন।
ঘনকুয়াশায় দিনের বেলাও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলছে গাড়ি।
বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার (৩০ ডিসেম্বর) এ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনের ও রাতের তাপমাত্রা হ্রাস পাচ্ছে।
পৌষ মাসের শুরু থেকেই এ জেলায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে জনজীবনে। পাশাপাশি হিমেল হাওয়ার সঙ্গে কুয়াশাও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে গ্রাম থেকে শহরে জেঁকে বসেছে শীত। জেলায় শেষ রাত থেকে শুরু করে ভোর পর্যন্ত ঘন কুয়াশার সৃষ্টি হচ্ছে। বেলা বাড়লে মাত্রা অনেকটা কমে এলেও হালকা কুয়াশা চোখে পড়ছে। এছাড়া বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্য উঁকি দিলেও তাপ ছড়াচ্ছে না। ঠাণ্ডার দাপটের কাছে যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে সূর্যটাও।
তীব্র শীতের কষ্টে পড়েছেন এ অঞ্চলের শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। জীবন জীবিকার তাগিদে শীত উপেক্ষা করে তাদের রুটি-রুজির সন্ধানে ঘরের বাইরে বের হতে হচ্ছে। ঠাণ্ডার মধ্যে ভোরের আলো ফোটার আগেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ছেন তারা। রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইকসহ শহরের বিভিন্ন মোড়ের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো সন্ধ্যার পর থেকেই কমতে শুরু করে। তবে ভিড় বেড়েছে শহরের নতুন ও পুরনো শীতবস্ত্রের দোকানগুলোই। আর শহরের থেকে গ্রামের দিকে শীতের তীব্রতা বেশি। গ্রাম এলাকায় হিমেল হাওয়া ও কুয়াশাও বেশি পড়ছে। সঙ্গত কারণে তাপমাত্রাও গ্রামের দিকে কিছুটা কম।
গ্রামাঞ্চলের নিম্নবিত্ত ও ছিন্নমূল মানুষেরা জানান, শীতের তীব্রতা ও গরম কাপড়ের অভাবে কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটছে। সঠিক সময়ে কাজে যেতে পারছেন না তারা। তাই শীতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ।
চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের রেলবাজার এলাকার রিকশাচালক আলমগীর হোসেন বলেন, হঠাৎ করেই শীত বেড়ে গেছে। সকালে ও রাতে জোরে রিকশা চালালে শরীরে বাতাস সূচের মতো ফুটছে। হাত পা অবসের মতো হয়ে যাচ্ছে।
রাতে চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, শীতে ছিন্নমূল মানুষেরা স্টেশনের বারান্দায় ছেঁড়া কাঁথা-কম্বল কিংবা বস্তা দিয়ে নিজেকে মুড়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। তবুও শীতে কাঁপছেন অসহায় মানুষগুলো। কনকরে ঠাণ্ডায় এ জেলায় ঘুরতে এসে বিপাকে পড়েছেন অনেকে। ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনে বসে থাকাও যেন শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করার সামান হয়েছে যাত্রীদের কাছে।
চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশনের বারান্দায় বসে থাকা মাহাবুব মোরশেদ কাঁপতে কাঁপতে বলেন, ভাই খুব কষ্ট হচ্ছে। দুদিনের জন্য ঢাকা থেকে দুই বন্ধুকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় বেড়াতে এসেছিলাম। এর মধ্যে যেদিন চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছেছি সেদিনই এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। আমি কোনো মতে টিকে থাকলেও দুই বন্ধু শীতে কাহিল।
শীত বৃদ্ধি পাওয়ায় চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার, নিউ মার্কেট ও নিকসন মার্কেটসহ বিভিন্ন মের্কেটে ভিড় বেড়েছে। শীতের পোশাকের বেচাবিক্রিও বেড়েছে বলে বিক্রেতারা জানিয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শীতের পোশাক ও আনুষঙ্গিকের বিক্রি মোটামুটি ভালো। তবে শীতের দাপটে মানুষ বাইরে কম বের হচ্ছে, সন্ধ্যার পর থেকেয় শহরে লোকজনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সকালের পর ব্যবসা একটু চাঙ্গা থাকছে।
নিউ মার্কেটের পোশাক ব্যবসায়ী সুমন পারভেজ বলেন, শীত বাড়ায় শীত পোশাক বিক্রিয় বেড়েছে। সন্ধ্যা ও রাতের তুলনায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্রেতারা বেশি আসছেন। এ বছরও বাহারি শীত পোশাকে দোকান সাজানো হয়েছে।
শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা। প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। চুয়াডাঙ্গার ১০০ শয্যার হাসপাতালে শিশুদের জন্য ১৫টি শয্যা বরাদ্দ থাকলেও গত কয়েকদিন ধরে শয্যার থেকে কয়েকগুণের বেশি ঠাণ্ডাজনিত নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও অ্যাজমা আক্রান্ত শিশু ভর্তি হয়েছে।
দামুড়হুদা উপজেলার বাসিন্দা শাপলা খাতুন বলেন, গত বুধবার থেকে তার মেয়ে ঠান্ডা রোগে আক্রান্ত হয়। দামুড়হুদা থেকে চিকিৎসা করালেও সুস্থ না হওয়ায় বৃহস্পতিবার মেয়েকে সদর হাসপাতালে আনলে চিকিৎসক ভর্তি রাখে। শিশু ওয়ার্ডে কোনো বেড খালি নেই, তাই শিশু মেয়েকে নিয়ে ওয়ার্ডের ফ্লোরে বসে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। হাসপাতালের টয়লেট ও ফ্লোর নোংরা। শীতের ঠান্ডা বাতাসে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শীতের কারণে রোগ ভাল হচ্ছেনা।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমান মিলন বলেন, শীত যত বাড়ছে হাসপাতালের অন্তঃবিভাগে শিশু রোগী ভর্তির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন বহির্বিভাগেও ২০০ জনেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামাল দিয়ে হাসপাতালের সেবিকাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। শীতের সময় দেখা যায় যে শিশুরা পোশাক ঠিক মতো পড়তে চায় না, কানটা হয়তো বাইরে থাকে, ঠাণ্ডা পানি খায় ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে পরে। শীতের সময় বাতাসে জীবাণু বেশি থাকে। বিশেষ করে ভাইরাস বেশি থাকে যা শ্বাস নালীর মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও মামসের মতো রোগের সৃষ্টি করে।
চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, চুয়াডাঙ্গায় কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ বিরাজ করছে। যার ফলে তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। তবে বাতাসের আর্দ্রতা অনেক বেশি। ৯৭ ভাগ আর্দ্রতায় শীত অনুভূত হচ্ছে। শুক্রবার দেশে শৈত্যপ্রবাহের আওতা না বাড়লেও দিনের বেশির ভাগ অংশে কুয়াশা থাকায় শীতের মাত্রা বেড়েছে অনেক বেশি। রাতে শীতের তেমন উন্নতি না ঘটলেও দিনে শীত বাড়বে না। আগামী সোমবারের দিকে তাপমাত্রা সামান্য বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।