Homeআন্তর্জাতিকদুর্দশা পিছু ছাড়েনি আফগানদের

দুর্দশা পিছু ছাড়েনি আফগানদের

দীর্ঘ দুই দশক পর গত বছরের ১৫ আগস্ট পুনরায় আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। স্বঘোষিত বিজয়ের ফলে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে নানা সমীকরণের মুখোমুখি হয় দেশটি। তালেবানরা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর দেশটির সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে।

মানবিক, জলবায়ু, ক্ষুধাসহ নানা সংকটে বিপর্যস্ত আফগানিস্তান। তালেবান সরকারের জন্য অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও রিজার্ভ বন্ধ করার কারণে দেশটির অর্থনীতি তারল্য সংকটে ভুগছে। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে আরও খারাপ হচ্ছে। অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নারী শিক্ষাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেশটির মানুষের জীবন-যাপন কঠিন হয়ে পড়েছে।

ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালেবান আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মধ্যপন্থি নীতি পালনের কথা বলেছিল। তাদের মূল অঙ্গীকার ছিল নারীদের অধিকার। কিন্তু তারা সেই কথা রাখেনি। শরিয়তি আইন মেনে নারীদের অধিকারের কথা বলেছিল তালেবান মুখপাত্র, তবে সেই অঙ্গিকারও রক্ষা করছে না তারা।

এদিকে দেশটিতে বর্তমানে অপুষ্টির হার বাড়ছে, নারীর অধিকার খর্ব হয়েছে, অভিবাসন এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি অব্যাহত রয়েছে। ভেঙে পড়ছে স্বাস্থ্য পরিষেবা।

নারী শিক্ষা
ক্ষমতা দখলের পর একের পর এক ‘নারীবিরোধী পদক্ষেপ’ নিতে থাকে তালেবানরা। সবশেষ মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের নিষিদ্ধ করে তালেবান সরকার। সরকারের উচ্চশিক্ষা বিষয়কমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জারি করা এক চিঠিতে এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আফগানিস্তানে নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় আফগান নারীদের প্রবেশাধিকার আরও সীমিত হয়ে গেল। দেশটিতে ইতোমধ্যে বেশিরভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীরা বাদ পড়েছে।

পূর্ণ শরিয়া আইন প্রয়োগ
সম্প্রতি বিচারকদের পূর্ণ শরিয়া আইন প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা। তিনি বলেছেন, ডাকাতি, অপহরণ এবং রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধের শাস্তি অবশ্যই ইসলামি শরিয়া আইন অনুযায়ী দিতে হবে।

শরিয়া আইনে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি হিসেবে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, পাথর নিক্ষেপ, চাবুক মারা এবং হাতের কবজি কাটার মতো বিধান রয়েছে।

নব্বইয়ের দশকে ক্ষমতায় থাকাকালীন তালেবানদের এ ধরনের শাস্তি প্রয়োগের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। গত বছর পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর তারা আগের চেয়ে তুলনামূলক কম চরমপন্থা অবলম্বনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে গত এক বছরের বেশি শাসনামলে তারা ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছে।

ক্ষুধা
আফগানিস্তান দারিদ্র্যে জর্জরিত একটি দেশ। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে দারিদ্র্যের সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট আরও বেড়ে যায়। তীব্র খরার সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি। শিশুসহ আফগানিস্তানের বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষুধায় ভুগছে। দেশটির তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে ৬০ লাখ মানুষ। দেশটির ১০ লাখেরও বেশি শিশু ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে।

বিদেশি সাহায্যে জটিলতা
তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হলে দেশটিতে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্ট হয়। তালেবানের ক্ষমতা দখল দেশটিকে আরও গভীর খাদে ফেলে দেয়। আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে গেলে দেশটির বিদেশি সাহায্য রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটি আরও বিপদে পড়ে।

আফগানিস্তানের জিডিপির ৪৫ শতাংশ বিদেশি সাহায্যনির্ভর হওয়ায় দেশটি চরম সংকটে পড়ে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৭ বিলিয়ন ডলার অর্থ আটকে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে দেশটির ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়ে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আফগানিস্তানের জন্য আরও উদ্বেগের কারণ হতে পারে। ২০২২ সালেও তালেবানদের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অধরাই থেকে গেছে। এক বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পরও কোনো বিদেশি দেশ তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। যদিও চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানসহ ১৬টির বেশি দেশ কাবুলে দূতাবাস চালু রেখেছে।

তালেবান শাসকরা বিশ্বের সঙ্গে আরও সম্পৃক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা জানালেও, তাদের কঠোর নীতি অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তালেবান সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার উন্নতিকে অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে নির্ধারণ করেছে।

জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন উপরাষ্ট্রদূত রবার্ট উড তালেবানের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘তালেবানরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৈধ সদস্য হওয়ার আশা করতে পারে না, যতক্ষণ না তারা সমস্ত আফগানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে। বিশেষ করে মানবাধিকার এবং নারী ও মেয়েদের মৌলিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা।’

বিদেশিদের দাবি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ তালেবানদের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের ওপর জোর দিয়েছে। দেশটিতে মানবাধিকার রক্ষা, বিশেষ করে নারীর অধিকার এবং আফগানিস্তান যাতে অন্য রাষ্ট্রের সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে পরিণত না হয় সেই বিষয়গুলো দেশটির সরকারকে নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে আসছে।

এ ছাড়া তালেবান সরকারের দমনমূলক এবং কট্টর নীতির সমালোচনাও রয়েছে। নারী ও মেয়েদের ওপর বর্ধিত বিধিনিষেধের পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা, মার্কিন গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা এবং রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টির সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা ১৯৯০’র দশকে তালেবান শাসনের বিভীষিকার কথা মনে করিয়ে দেয়।

তালেবানের মধ্যে মতবিরোধ
বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ইয়োগিতা লিমায়ের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তালেবান সরকার নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করবে এমন শঙ্কা আগেই ছিল। কয়েক সপ্তাহ আগে একজন নারী শিক্ষার্থী এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘একদিন আমরা ঘুম থেকে উঠে শুনবো যে, নারীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’

এর আগে গত মাসে পার্ক, জিম এবং সুইমিং পুল থেকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে নারীদের।

ক্ষমতা গ্রহণের পর তালেবান নেতাদের বক্তব্যে থেকে এটা স্পষ্ট যে, মেয়েদের শিক্ষার ইস্যুতে তাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কিছু তালেবান সদস্য বারবার বলছেন যে, তারা আশাবাদী এবং তারা মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। তবে একের পর এক নারীবিরোধী সিদ্ধান্তে তালেবানের মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

কমেছে সহিংসতা
তালেবানদের হাতে পশ্চিমা-সমর্থিত ঘানি সরকারের পতনের পর থেকে আফগানিস্তানে সহিংসতার হার দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। ক্রাইসিস গ্রুপ নামে একটি থিংক-ট্যাংকের ধারণা, ২০২২ সালের জুলাই থেকে সহিংস ঘটনার সংখ্যা এক বছরের আগের একই সময়ের তুলনায় ৮৭ শতাংশ কমে গেছে।

তবে এই সময়ে পাল্লা দিয়ে দেশটিতে বেড়েছে দারিদ্রতা। রাজনৈতিক সহিংসতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এমন একটি এনজিওর তথ্যানুসারে, ২০১১ সাল থেকে তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা গ্রহণের পর বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ৫০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। ড্রোন এবং বিমান হামলা হ্রাস পেয়েছে ৯৬ শতাংশ। ল্যান্ডমাইন এবং ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) বিস্ফোরণ কমেছে ৭৩ শতাংশ এবং গোলাগুলি ও সমর যানের আক্রমণ কমেছে ৯৭ শতাংশ। তবে এসব সাফল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে দারিদ্রতার কষাঘাতে।

আইএস ইস্যু
তালেবানদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কট্টরপন্থি গ্রুপ ইসলামিক স্টেট। তালেবান ও আইএস উভয়ই সুন্নি চরমপন্থি গোষ্ঠী। কিন্তু তারা মিত্র নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী। আইএসের উদ্দেশ্য আফগানিস্তানে আইএস খোরাসান প্রদেশ প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্লেষকরা তালেবানকে আইএসের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবেই দেখছেন।

বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও বাড়ছে। বিশ্ব বাস্তবতায় আফগান নাগরিকদের দুর্দশা সহজেই কাটছে না। দেশটির লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করায় সামনের দিনগুলোতে নাগরিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে তালেবানের শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে আফগানদের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠারও শঙ্কা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর