জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার পরিস্থিতি বিষয়ক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) ভোরে প্রস্তাবটি ১২-০ ভোটে অনুমোদিত হয়।
এতে মিয়ানমারে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অবসান এবং দেশটির সামরিক শাসকদের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা অং সান সু চিসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। ভোটাভুটিতে দিলে ১২-০তে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। খবর আল-জাজিরার।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে। এরপর তাকে এবং অন্যান্য কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে এবং গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভ এবং ভিন্নমত দমনে সক্রিয় হয়। ক্ষমতা দখলের পর তারা কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং ১৬ হাজারের বেশি মানুষকে জেলে পাঠায়।
ভোটাভুটি পর্বে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনার বিপক্ষে কোনো সদস্য ভোট অথবা ভেটো প্রদান করেনি। চীন, ভারত ও রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল। ভোটদান শেষে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, মেক্সিকো, গ্যাবন এবং নরওয়ে তাদের বক্তব্যে প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রশংসা করে এ সমস্যা সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের জোরালো ভূমিকার দাবি জানান।
যুক্তরাষ্ট্র তার বক্তব্যে প্রস্তাবটি উত্থাপন করার জন্য যুক্তরাজ্যকে ধন্যবাদ জানায়। বলা যায়, এই রেজুলেশনটি রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের প্রতি জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অঙ্গটির শক্তিশালী সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটসহ অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে গ্রহণ করা প্রস্তাবটি রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আরও সুসংহত করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ২০১৭ সালে ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাসহ এ পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে তাদের অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় দেন এবং শুরু থেকেই তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে জোরালো দাবি উত্থাপন করে আসছেন। এ প্রস্তাবনা অনুমোদিত হওয়ায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের নিয়মিত কার্যকলাপের অংশ হয়ে গেল।
একই সঙ্গে এটি রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের এ সংক্রান্ত অব্যাহত প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী ও ত্বরান্বিত করবে। প্রস্তাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও মানবিক সহযোগিতা দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করা হয়। পরিষদ রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তাদের নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানায়। মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা যে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ বাসভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে, সে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়।
এছাড়া, এ সমস্যার সমাধানে আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ২০২১ সালে গৃহীত পাঁচ দফা ঐক্যমত্যের দ্রুত ও পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং এর বাস্তবায়নে জাতিসংঘের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হবে কিনা সে বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূতকে আগামী বছরের ১৫ মার্চের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন পেশ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন প্রস্তাবটিতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী ও অস্থায়ী বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের সাথে প্রয়োজনীয় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এবং বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যাতে প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
উল্লেখ্য, প্রস্তাবটির মূল স্পন্সর পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্য যুক্তরাজ্য। বিগত তিনমাস ধরে রেজুলেশনটি নেগোশিয়েশন শেষে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হয়। নিরাপত্তা পরিষদের ডিসেম্বর ২০২২-এর সভাপতি ভারত এবং তাদের সভাপতি থাকাকালীন সময়েই রেজুলেশনটি নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হলো। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টায় সফল হলো বাংলাদেশ।